চৌরঙ্গী
বইবাজার মূল্য : ৳ ৩০৮ (১৮% ছাড়ে)
মুদ্রিত মূল্য : ৳ ৩৭৫
প্রকাশনী : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)
বিষয় : উপন্যাস, গল্প ও নাটক
This book is Out of Print
খালি চোখে আমরা যা দেখি তা ই কি সব? না। বাইরে থেকে খালি চোখে আমরা যা দেখতে পাই তা একশ ভাগের কয়েক ভাগ মাত্র। এমন অনেক কিছু আছে যা বাইরে থেকে দেখা যায় না। সেগুলো দেখত হলে অন্দরে ঢুকতে হয়, অন্তরের চোখ খুলে তাকাতে হয়। ঠিক তেমনটাই হোটেল শাহজাহান এর বেলাতেও। বাইরে থেকে সর্বদা হাসিখুশি আর জাকজমকপূর্ণ হোটেলের অন্দরমহলে এক অন্য জীবন আছে। সেই জীবনটা সাধারণ মানুষ যা দেখে তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই জীবনে হাসি আছে, কান্না আছে, ভালোবাসা আছে, আছে বিশ্বাসঘাতকতাও। কিছুসময়ের জন্য সেই জীবনে ডুব দিতে চাইলে পড়ে ফেলতে পারো শংকরের লেখা 'চৌরঙ্গী' উপন্যাসটি। . ক্লাস আর বাসের চাপে পিষ্ট হয়ে জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখনই খোঁজ পাই বেঙ্গল বইয়ের। সেখানে নাকি ফ্রি ফ্রি বই পড়া যায়। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন বেঙ্গল বইয়ে যাওয়া রুটিন হয়ে যায়। আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন বেঙ্গল বইয়ে মোটা মোটা বই পড়া নিয়ে কোন রেস্ট্রিকশন ছিল না। বইয়ের তাক খুঁজতে খুঁজতে একদিন চোখে পড়লো বিভিন্ন রঙে রঙিন মলাটের একটা বই, নাম তার চৌরঙ্গী। লেখকের নাম শংকর। এত এত বই পড়া হয়ে গেল, কিন্তু এই লেখকের কোন বই পড়ি নি তখনো। তাই কিছুটা নতুন লেখা চেখে দেখার ইচ্ছা আর কিছুটা রঙিন মলাটের আকর্ষণেই তাক থেকে নামিয়ে নিলাম বইটি। একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসলাম। প্রথম দুই তিন পৃষ্ঠা পড়ে একবার মনে হয়েছিল অন্য বই নিই। মন বিক্ষিপ্ত থাকার কারণে ভালো লাগছিল না। কিন্তু তারপরই আবিষ্কার করলাম বইটা না রেখে মোটেও ভুল করি নি। পড়তে পড়তে লেখকের সাথে ঢুকে গেলাম হোটেল শাহজাহান এর অন্দরে। . শংকরের লেখা পড়া ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তার গল্প বলার ধরণ। খুব সাবলীল বর্ণনার মাধ্যমে তিনি পুরো শাহজাহান হোটেলের অন্দরের খবর তুলে ধরেছেন। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এক সৈনিকের বায়রন সাহেবের হাত ধরে শাহজাহান হোটেলে ঢুকে পড়া থেকে শুরু করে বরখাস্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত গল্পটা তিনি এমনভাবে লিখেছেন যে একবার শুরু করলে শেষ না করে উঠার উপায় নেই। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল যেন আমি নিজেই ঘুরে বেড়াচ্ছি চৌরঙ্গীর আশেপাশে, শাহজাহান হোটেলের ভেতরে কিংবা হোটেলের সবচেয়ে উপরের তলার সেই ঘুপচি ঘরগুলোতে। সত্যসুন্দর বোস ওরফে স্যাটা বোস, মার্কো পোলো, পি সি গোমেজ ওরফে প্রভাত চন্দ্র গোমেজ, ডাক্তার সাদারল্যান্ড, করবী দেবী, শংকর, গুড়বেড়িয়া, জেন, নিত্যহরিদা ওরফে ন্যাটা, বায়রন সাহেব, কনি আর ল্যামব্রেটা, রোজী- শাহজাহান হোটেলের বুকে বিচরণ করে বেড়ানো প্রত্যেককে চোখের সামনে দেখছি বলেই মনে হচ্ছিল। . উপন্যাসের শুরুটা হয় হুট করেই চাকরি হারিয়ে সেলসম্যানের কাজ শুরু করতে থাকা শংকরকে দিয়ে। অতীত জীবনে বায়রন নামের কোন এক কালো সাহেবের সাথে ভালো ব্যবহার করায় বায়রন সাহেবের হাত ধরেই তার প্রবেশ ঘটে হোটেল শাহজাহান এর অন্দরমহলে। তারপর একেকটি ঘটনার সাথে সাথে সমৃদ্ধ হতে থাকে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি। হোটেল শাহজাহান এ কাজ করার সুবাদে সে দেখতে পারে সমাজের উঁচুতলার মানুষের মুখোশের আড়ালে তাদের আসল জীবন। আবার নানারকম কর্মচারীর সাথে মেশার সুবাদে দেখতে পারে মানুষগুলো কত সহজ সরল। তার এই উপলব্ধির প্রকাশ পাওয়া যায় একটি উক্তিতে - "কী আশ্চর্য এই পৃথিবী! বেঁচে থাকার সমস্যা সমাধান করতে করতেই কত নিষ্পাপ লোকের সমগ্র সামর্থ্য ব্যয়িত হচ্ছে; আর যাদের অন্নচিন্তা নেই, একঘেয়ে সুখে ক্লান্ত হয়ে তারা শখের সমস্যা তৈরি করছে।" . হোটেল রিসেপশনিস্ট শংকরের দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক মূলত আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোরই একটা চিত্র আঁকতে চেয়েছেন। সেই সাথে বুঝাতে চেয়েছেন কখনো কখনো নিয়তির কাছে খুব ক্ষমতাবান মানুষটিও অসহায়। যদিও সবাই একটা মেকি মুখোশে নিজের আসল চেহারাটা ঢেকে রাখে, কিন্তু কিছুটা সময়ের জন্য হলেও সেই মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। খুব সরল উক্তির মধ্য দিয়ে উপন্যাসের মাঝে মাঝেই তিনি কিছু কঠিন বাস্তব কথা তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের একেকটি চরিত্রের জীবনের গল্প আমাদের একেকটি নতুন শিক্ষা দিয়ে যায়। সত্যি বলতে এক চৌরঙ্গী উপন্যাস আমাকে যা শিখিয়েছে, আর কোন বই পড়ে আমি তা শিখতে পারিনি। উপন্যাসের শেষটা হয় হোটেল শাহজাহান থেকে শংকরের বিদায় নেয়ার মাধ্যমে। প্রিয় মুখগুলোর একে একে বিদায়ের পর ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তে শংকরকেও বিদায় নিতে হয় হোটেল শাহজাহান থেকে। শেষটা ঠিক শেষ এর মতই- আমার তাই মনে হয়েছে। . কেউ যদি আমাকের একটা বই সাজেস্ট করতে বলে, আমি কোন দ্বিধা ছাড়াই বলি- শংকরের 'চৌরঙ্গী'। শংকরের অন্য বইগুলোও খুবই চমৎকার। তবে চৌরঙ্গী আমার মনে যে দাগ ফেলেছে তা অন্যগুলো পারেনি। তাই আমি সবাইকে বলব সময় পেলে বইটি পড়ে ফেলতে। আমি নিশ্চিত যে বইটি সবার ভালো লাগবেই। #বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯