ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ সকল দেশের মানুষই এক। আমাদের লোককবি বলিয়াছেন- ‘নানান বরন গাভীরে ভাই একই বরন দুধ-আমি জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত’।
‘সব দেশেরই মানুষ তাই ভালো। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিবাদ হয় তাহাতেও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা যায় না। আমার এই ভ্রমণ কাহিনীতে সেই মানুষের কথাই বলিয়াছি। মানুষকে যাঁহারা মনের মিতালি গড়িয়ে চান আমার এই পুস্তক পড়িয়া তাঁহারা কিছুটা মনের তৃপ্তি পাইবেন’।
“আবার দেশে ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছা করে না? জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা উত্তর করিল, “দেশের মাটি, বাতাস সবসময়ই আমাদের আকর্ষণ করিতেছে; কিন্তু দেশ তো আমরা চিরজনমের মতো হারাইয়া আসিয়াছি। আমাদের বাড়ি-ঘর সব লুট হইয়া গিয়াছে। আর কি কোনোদিন দেশে ফিরিয়া যাইতে পারিব? ‘সেদিন দেখি আমার ঘরের দরজায় একখানা চিঠি, তাহাতে খোকা লিখিয়াছে, কাল শুক্রবার সন্ধ্যায় আমার মা আপনাকে সান্ধ্যভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। এই গরিব ছেলের বাড়িতে যাইয়া নিমন্ত্রণ খাইয়া তাহাদের বৃথা খরচের মধ্যে ফেলিতে মনে বড়িই সঙ্কোচ লাগিতেছিল। তা ছাড়া কালকে আমার অন্য নৈশভোজনের নিমন্ত্রণ আছে। তাড়াতাড়ি সেই ছেলেটিকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া বলিলাম, খোকা! কাল আমার অন্য জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে। আমি যদি পাঁচটা হইতে ছয়টা পর্যন্ত তোমাদের বাড়িতে যাইয়া গল্পসল্প করিয়া আসি, তবে কেমন হয়? খোকা সানন্দে রাজি হইল’।
জসীম উদদীন
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গােবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তার শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে রিসার্চ ফেলাে’ পদে কর্মরত ছিলেন। দীনেশ সেন সেই দিনগুলােতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুঁথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন। ড. সেন তাঁর উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদদীনকে বাংলার জেলাগুলাের বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লােকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদ্দীন পুঁথি সংগ্রহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালােবেসে একজন খাটি মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লােকগীতির আসরে যেতেন, উপভােগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লােকসঙ্গীতের আসরের আয়ােজন করতেন। তিনি বেশকিছু লােকগীতিতে সুরারােপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান। শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন।
কবি পৃথিবীর বহুদেশ সফরকালে সেইসব দেশের লােকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদ্দীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্রবন্ধ, লােকসাহিত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবার্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও যুগােস্লাভিয়াসহ বহু দেশে অনেক লােকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলাে বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে ; ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট' বইটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করে। কবির ‘মাটির কান্না কাব্যগ্রন্থটির রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলােক ত্যাগ করেন।