বর্তমান পুস্তকের অন্তর্গত সাক্ষাৎকারসমূহ গ্রহণের সময়কাল মার্চ ২০২১ থেকে অক্টোবর ২০২২ সাল। অর্থাৎ দেড় বছর ধরে সাক্ষাৎকারগুলো নেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট চিন্তকদের বইপত্র, লেখাঝোখা আমাকে নিবিড়ভাবে পড়তে হয়েছে, সেখান থেকে কোন কোন বিষয় ধরে আলোচনা এগিয়ে নেব তা নির্ধারণ করতে হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, এই জার্নি আমার জন্য অত্যন্ত পরিশ্রমের এবং আনন্দের ছিল। প্রচ্ছদে উল্লিখিত পাঁচজন বিশিষ্ট চিন্তকের সর্বমোট সাতটি সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। সাধারণত সাক্ষাৎকার যেমন হয়ে থাকে, এই বইয়ের সাক্ষাৎকারসমূহ সম্ভবত তার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের হবে। কারণ যে সমস্ত বিষয় এখানে আলোচিত হয়েছে, সম্মানিত পাঠকবৃন্দ সেইসব বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গিও খানিকটা আঁচ করতে পারবেন বোধকরি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নটা উপলক্ষ মাত্র, প্রশ্নের আগের আলোচনাটাই মূল। তবে স্বীকার করে নেয়া ভালো, জরুরি প্রতিচিন্তা বের করে আনার স্বার্থে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রতাপশালী ডিসকোর্সের পক্ষে আমি ডেভিল’স অ্যাডভোকেসি করেছি। ওইসব ক্ষেত্রে ওই মতগুলোতে আমার আস্থা না থাকলেও মতগুলোর জায়গা থেকে আলাপটা তুলেছি, যেন কার্যকর সমালোচনা উঠে আসে। তত্ত্ব এই বইয়ে আমার অন্যতম প্রধান মনোযোগের বিষয় হিসেবে থেকেছে। কারণ দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনীতি, অ্যাক্ টিভিজম কিংবা এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রেও, বাংলাদেশে, তত্ত্ব প্রশ্নে মোটাদাগে তিন ধরনের অবস্থান দেখা যায়। এক, তত্ত্ববিমুখতা তথা তত্ত্ব করাকে বিলাসিতা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পলায়নপরতা হিসেবে বিবেচনা করা। দুই, ইতিমধ্যে প্রাপ্ত তত্ত্বের ব্যাপারে নিঃসংশয় থাকা এবং সেগুলোর পুনর্তদন্তে অনীহা। তিন, তত্ত্ব যা করা দরকার তা আমরা করে ফেলেছি, এখন কেবল ধর তক্তা মারো পেরেক-এমন মনোভাব। বলা বাহুল্য, এই তিন অবস্থানই ক্ষতিকর। কারণ প্রথম এবং সবচেয়ে যুতসই প্রতিরোধটা তত্ত্ব থেকেই আসে। প্রায়ই দেখা যায়, যেকোনো ক্ষমতাশীল বিদ্যমানতার যারা বিরোধিতা করছেন, তারা আর তাদের ক্ষমতাবান প্রতিপক্ষ-উভয়ে একই তাত্ত্বিক প্যারাডাইমে অবস্থান করছেন। কাজেই অধিপতিশীল ক্ষমতার বিরোধিতা করে সেই একই জিনিসে পর্যবসিত হতে না চাইলে সবার আগে দরকার তাত্ত্বিক ভিন্নতা। অবশ্য আপাত ন্যায়সঙ্গত কিংবা বিপ্লবী মতাদর্শের মোড়কে ক্ষমতা চর্চা করতে চাইলে কথা ভিন্ন। একটা সম্পূর্ণ নতুন তাত্ত্বিক ভাষার জগত-পুরোনো সমস্ত কিছুকে সটান ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নয়, নতুন সচেতনতার সাথে পুরোনো চিন্তাকে হালনাগাদ করে নিয়ে— নির্মাণের চেষ্টা আমার কাছে এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তব্য বলে মনে হয়। সে কারণেই তত্ত্ব ও তৎপরতার একটা কার্যকর যুগলবন্দী খুঁজে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার ছাপ এই বইয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এই পুস্তকে পাঁচজন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক ও চিন্তকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা গড়ে তোলা হয়েছে-তা ইতিমধ্যে উল্লিখিত। যে পাঁচজন তাত্ত্বিকের সাথে আমার আলাপচারিতার সুযোগ ঘটেছে, তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব কাজের ক্ষেত্রে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যায়তনিক ও ক্রিটিক্যাল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিসরে বহুল পরিচিত-পঠিত। মূলত তাঁদের কাজের এলাকাগুলোর সাথে বাংলাদেশের ভাবুক ও চিন্তাশীল পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়ার তাড়না এই সাক্ষাৎকারগুলোর অন্যতম অনুঘটক। এছাড়াও আলোচনায় সেইসকল বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশের জনপরিসরের এবং প্রাত্যহিক জনজীবনের জ্বলন্ত বিষয়। আলাপচারিতাটা গড়ে তুলবার সময়ে আমার মূল ঝোঁক ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাস্তবতার প্রতি খেয়াল রাখা। সেটা কতটা করতে পেরেছি বা আদৌ পেরেছি কি না তার বিচারের ভার পাঠকের দরবারে। এ পরিসরে কেবল এইটুকু বলা জরুরি, এই বইয়ের সাক্ষাৎকারসমূহ আমার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়াকে ঝালাই করার ক্ষেত্রে বিপুলভাবে সহায়ক হয়েছে; আশা করি তার কিছু নজির এই বইয়ে পেশ করতে পেরেছি। সংশ্লিষ্ট চিন্তকদের বইপত্র ও লেখাঝোখা পড়তে পড়তে টেক্সট পাঠের কলাকৌশল রপ্ত করার ক্ষেত্রেও একটা জবরদস্ত মহড়া হয়েছে-প্রাপ্তি হিসেবে এর মূল্যও নেহায়েত কম নয়। বইটি পড়ার সময়ে বিদগ্ধ পাঠকবৃন্দ এই মশহুর চিন্তকদের পাশাপাশি আমাকেও পড়বেন সেই আশাবাদ রাখছি।