চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক (হার্ডকভার)
মানুষের জীবনের গল্পটা অনেক বেশিই অদ্ভুত রকমের হয়। শত রকমের,শত রঙের বুননে ঠাসা। স্বল্প দিনের, অথচ সহস্র জটিলতায় পরিপূর্ণ এক জীবনে শত পাওয়া-না-পাওয়ার সমীকরণ একদিকে যেমন থাকে, তেমনি অন্যদিকে থাকে অনেক অজানা বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির বিবরণগাঁথা। সেসব বিবরণগাঁথাকে শ্বাপদসংকুল বললেও বোধহয় তেমন অত্যুক্তি হবে না। যেকোনো পরিস্থিতি বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করা কেবল একজন সাহসী মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়। জীবনের এই অন্যতম দিক বিপদের মুহূর্তে সাহসিকতার গল্প নিয়ে লেখা এক উপন্যাসের নাম “চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক”। কিশোর গল্প নিয়ে লেখা সাহিত্য কর্মের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চার কিশোরের সাহসিকতার গল্প নিয়ে গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার কাজে হাত দেওয়াটা সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত সাহসিক তরুণ লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাস এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন। সাহিত্য জগতের একজন নবীন পথিক হিসেবে তার অন্যান্য সাহিত্য কর্মের মতো এই উপন্যাসেও নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। বাংলা ভাষাভাষী পাঠক বৃদ্ধিতে এমন উদ্যোগ যে কতোটা সহায়ক ভূমিকা রাখবে, তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। “চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক” উপন্যাসের কাহিনি অত্যন্ত সুসংহত ও সুবিন্যস্ত। কাহিনি-গ্রন্থনায় লেখক অসামান্য পরিমিকিবোধের পরিচয় দিয়েছে। “সত্যি,বড়ো আজব শহর লন্ডন”বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে উপন্যাসের গল্প। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বাংলাদেশি ছেলে সুমন লন্ডনে মিসেস ম্যালথাসের বাসায় ভাড়া থাকতো। কিন্তু মিসেস ম্যালথাম বাসা ছেড়ে দিতে বললে দিশেহারা হয়ে যায় সে। এমন পরিস্থিতিতে ডেভিড মারটন নামের এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয় সুমনের। সুমনকে ডেভিড মারটন তাঁর আড়াই তলা বাড়িতে থাকার সুযোগ দেয়। এরপর এক অদ্ভুত কৌশলে বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়ে চাবি উদ্ধার করে সে। সময়ের পরিক্রমে সায়ান নামের এক নেপালিয়ান যুবককে বাড়িতে স্থান দেয় সুমন। নতুন বাড়িতে এসে এক অজানা রহস্যময়ী রমণীর শব্দে জ্ঞান হারায় সায়ান। হঠাৎ এমেল নামের এক মেয়েকে উদ্ধার করে স্থান দেয় আড়াই তলা বাড়িতে। এখানেই ঘটে যত বিপত্তি। এমেলের আগমনে পুরো গল্পের মোড় পাল্টে যায়। ড্রাগ মাফিয়ারা বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ ও ভয় দেখাতে থাকে তাদের। এমেলের শত্রু মাফিয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিল তার মা।বারংবার এমেলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে সুমন। ড্রাগ মাফিয়ারা ওদের ভয় দেখাতে মানুষের কান ও রক্তে লেখা চিঠি দেয়। সময়ের সাথে সায়ন ও এমেলের মধ্যে খুনসুটি চলতে থাকে সব সময়।অন্যদিকে দেশ,ভাষা,সংস্কৃতি সব ভুলে সুমন আর এমেলে মধ্যে অন্য রকম এক সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। এক সময় তাদের আশ্রয়দাতা ডেভিড বন্দি করে মাফিয়ারা। ডেভিডকে বাঁচাতে চিলিংহ্যাম দুর্গে ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সুমন,এমেল,সায়ান ও মাইক এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে নামে। এ অভিযান থেকেই জানা যায় ডেভিডই এমেলে পিতা।বেজমেন্টের ভগ্নপ্রায় কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সহসাই ঘটে অঘটন। ধরা পড়ে যায় ওরা।শেষবারের মত নিজেদের বাঁচাতে ক্লোরোফর্ম টিউব ব্যবহার করলেও হিতে বিপরীত কাজ হয়। কী হবে ওদের ভবিষ্যৎ? সুমন কী পারবে এমেলকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে? ওরা কি পারবে বিপদে বারংবার সাহায্য করা ডেভিডকে বাঁচাতে? মা নামের কলঙ্ক এলিটকে কি শাস্তি দিতে পারবে এমেল? শেষ পর্যন্ত ওরা কি ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সফল,না ব্যর্থ হবে? কী হয়েছি এমেল ও সুমনের ভালোবাসার পরিনতি? জানতে হলে বইপ্রেমীদের অবশ্যই পড়তে হবে এই উপন্যাসটি। অরুন কুমার বিশ্বাস যে অসাধারন কুশলী শিল্পী তা তাঁর “চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক” উপন্যাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় সুমন (হিমাংশু শেখর দত্ত)। গায়ের রং উজ্বল শ্যামলা,রোগাপটকা চেহারায় গোবেচারা ভাব সহজেই চোখে পড়বে। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন। বারবার অনুসরন করেছেন এবং তাঁর ওপরই আলো করে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন। তাঁরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। সুমন চরিত্রকে বন্ধুরা ভীতু বললেও সব সময় এ চরিত্রের মাধ্যমে সাহসিকতার রুপ ফুটে উঠেছে। সুমন রহস্য ভালোবাসে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, মৃত্যুকে খুব একটা পরোয়া করে না।দেশপ্রম ও উপকারী রূপটি ফুটে উঠেছে এ চরিত্রের মাধ্যমে। একজন বন্ধুভাবাপন্ন কিশোর হিসেবে ঔপন্যাসিক তাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সায়ান পাঠক। চাপা গায়ের রং,খাড়া নাক নেপালিয়ান ছেলে সায়ান। এ চরিত্র মূলত বুদ্ধিমত্তার প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভীতু প্রকৃতির সায়ানও অভিযানে সাহসের পরিচয় দেয়। সাহান রহস্য ভালোবাসে। উপরিক্ত চরিত্র দুটি বাদেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এমেল। বলতে গেলে গল্পের নায়িকা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে এ চরিত্রটি। এমেল চরিত্রের মাধ্যমে গল্পের মোড়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে সুমনের পাশাপাশি আরেকটি চরিত্র ছিল ডেভিড মারটেন। ডেভিডের কেউ নেই,অথচ পুরো বিশ্বাসটায় যেন তার। পরোপকার করা তার স্বভাব। সম্পূর্ণ গল্প জুড়ে অদ্ভুত ভাবে তথ্য না বলতেই জেনে যায় ডেভিড। যখনই তার প্রয়োজন অনুভব হয়েছে, তখনই উপস্থিত। উপন্যাসে স্বল্প সময়ে অবস্থান করেছে পিটার মাইক নামের চরিত্রটি। কিউবার ছেলে মাইক মৃত্যুকে পরোয়া করে না। অত্যন্ত সাহসী রুপে তুলে ধরা হয়েছে এ চরিত্রটি। উপরিক্ত চরিত্র ছাড়াও আরো কিছু চরিত্র যুক্ত হয়েছে উপন্যাসটিতে। মিসেস ম্যালথাম,মিহির,মিসেস বারবারা,মুলার,কেভিন,ম্যাক্স,এলিটা,প্রক্টার,অলিভিয়া,গ্যাম্বল,এলিজাবেথ চরিত্রগুলো উপন্যাসের কাহিনিকে বিস্তৃত ও আকষর্ণীয় করে তুলেছে।গল্পের প্রয়োজনে সৃষ্ট এসব চরিত্র উপরোক্ত চরিত্রদ্বয়ের মতো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও একেবারে ফেলনাও নয়।ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এসব চরিত্রের স্বার্থক চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের শিল্পগুন বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমার ধারনা।বইটি পড়লে কোনো সচেতন পাঠক এ ব্যাপারে দ্বিমত হবেন না বলে মনে হয় না। কোনো লেখার ভাষাশৈলী ও শব্দচয়ন সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে কথা বলাটাকে আমার কাছে দুনিয়ার অন্যতম জটিলতম ও দুরূহ কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু উক্ত বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে এবার সে কাজটাই করতে হচ্ছে। যেকোনো রচনার ক্ষেত্রে যেসব প্রধান শিল্পগুণ রয়েছে, তার মধ্যে প্রাঞ্জলতা অন্যতম। প্রাঞ্জলতা না থাকলে কোনো সাহিত্যকর্ম-ই আজকাল আর সেভাবে উঁচুদরের সাহিত্য মানের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। সেদিক থেকে এই উপন্যাসটিকে সার্থক বলা চলে। উপন্যাসটি মূলত বাংলা ভাষার চলিত রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এতে সাহিত্যমান কোথাও-ই বিন্দুমাত্র বিনষ্ট হয়নি। এমন মুন্সিয়ানার পরিচয় সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবি-দাওয়া রাখে। কিছু কিছু জায়গায় বাংলা হরফে ইংরেজি বাক্যে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোথাও তেমন কোনো জটিলতা চোখে পড়েনি আমার৷ এককথায়, ভাষার প্রাঞ্জলতা রক্ষার্থে ঔপন্যাসিকের চেষ্টা সত্যিকার অর্থেই পাঠকের নজর কাড়বে। উপন্যাসটির অন্য পাঠকেরা এই ব্যাপারে আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না বলে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। বইটি পাঠের মাধ্যমে লন্ডন শহরের পুলিশ ও পরিবহন খাতের ব্যাপক সুবিধা সম্পর্কে জানা যায়।এছাড়াও বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া,সংস্কৃতি ও খাবার সম্পর্কে জানা যাবে। বাংলাদেশের অতীত সম্পর্কেও ধারনা পাওয়া যাবে। উপন্যাসের পছন্দের কিছু বাক্য না বললেই নয়।যেমনঃ ** পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষেরা কেউই ক্লাসে প্রথম হয়নি। ** নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কান্না কোনো সমাধান নয়,এতে বরং শত্রুরা পেয়ে বসে। ** ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা উপেক্ষা করা যায় না। ** যুদ্ধক্ষেত্রে কখনো কখনো গোলাবারুদের চেয়ে চকোলেট বরং বেশি জরুরি হয়ে ওঠে। ** ভালোবাসা অপরাধ নয়, তবে স্থান-কাল-পাত্র বুঝে করতে হয়। ** নাচতে নেমে ঘোমটা টানার কোনো সুযোগ নেই। ** মা আর মাতৃভূমিকে যে ভালোবাসে না ,এই পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কিছু কিছু ছোটখাটো বিচ্যুতি পাঠক হিসেবে ভালো লাগেনি নিজের কাছে। কয়েকটা ভুল বানান একজন পাঠক হিসেবে নজর এড়ায়নি। সাধারণত মুদ্রণজনিত কারণে এই ভুল হয়ে থাকে বলে এর পেছনে সাহিত্যিকের কোনো ভূমিকা কিংবা অবদান থাকে না। তবুও এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আরেকটু সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল এড়ানো সম্ভব। আশা করি, সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে নজর দেবেন। ভাষাপ্রয়োগের ক্ষেত্রে ইদানীংকালে অতি আধুনিকতার নামে চলমান ভাষার অপ্রয়োজনীয় মিশ্রণ নজর এড়ায়নি। প্রথমদিকে অতিরিক্ত বাংলা হরফে ইংরেজি বাক্য লেখার বিষয়টা কিছুটা দৃষ্টিকটু লেগেছে। যদিও পরের দিকে এর পরিমান স্বাভাবিক করেছে। এছাড়াও ডেভিডের বাড়ির রহস্যময়ী রমণীর বিষয়টা অস্পষ্টই রয়ে গেছে। ৫৪ পেজে ডেভিডের বাড়ির সোফাটা ছাগলের চামড়ার বলা হলেও ১৩৮ পেজে বলা হয়েছে কুমিরের চামড়ার সোফা। বইয়ের বাঁধাই ও প্রচ্ছদ নিয়ে দু'একটি কথা না বললেই নয়। বাঁধাই খুব ভালো ও মজবুত হয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদটি গল্পের সাথে মিল রেখে চমৎকার ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ব্যাপারগুলোই অরুণ কুমার বিশ্বাস তার বইয়ের ক্যানভাসে তুলে এনেছেন, সুনিপুণ শব্দের জাল বুননের মধ্য দিয়ে। আমাদের চারপাশেই ঘটছে অনেক অপরাধ কর্ম! সেগুলোতে একদিকে যেমন কিশোর বয়সীদের অংশগ্রহণ দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, তেমনি অপরাধের রহস্য উদঘাটনে অনেক কিশোর রাখছে সাহসী ভূমিকা। ভালো আর মন্দ— এই দুই মিশেলেই যেকোনো সৃষ্টিকর্ম গড়ে ওঠে। সে হিসেবে কোনো সাহিত্যকর্মের সবকিছুই যে আমাদের ভালো লাগে, তা কিন্তু নয়। তেমন যদি কারোর লাগে, তবে বুঝতে হবে যে, উক্ত পাঠক মহোদয় আলোচ্য সাহিত্যিকের একজন অন্ধভক্ত। সবমিলিয়ে, দারুণ এক উপন্যাসের নাম "চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক"। প্রতিটি পাতায় তুমুল সাসপেন্সে ভরপুর এই উপন্যাস পাঠককে শেষ পাতা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। এর ঘটনার বিন্যাস আপনাকে বই ছেড়ে কিছুতেই উঠতে দিবে না। বিশ্বাস না হলে নিজেই পড়ে দেখুন না একবার। সবশেষে তরুন লেখক হিসেবে লেখকের জন্য শুভ কামনা রইলো। ভবিষ্যৎতে আরো সুন্দর,পরিমার্জিত লেখা প্রকাশ করে পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে, সেই আশা ব্যক্ত করি। নিজে বই কিনি, অন্যকে বই কিনতে উৎসাহিত করি। আর পিডিএফকে না বলি। ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৯/১০ রিভিউ প্রদানেঃ জান্নাতুল কলি শিক্ষার্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজবাড়ী সরকারি কলেজ।
অসাধারন একটি বই। বইটি পড়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে। তরুনদের জন্য অসাধারন একটি বই । লন্ডনের উপকন্ঠে কেন্ট সীমান্তে চিলিংহ্যাম দুর্গের ভূগর্ভস্থ কক্ষে ঢুকে পড়ে চার তরুণ অভিযাত্রী মাইক, সুমন, এমেল ও সায়ান। কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া কেভিন ও নেইল জরুরি সভায় ব্যস্ত মিস এলিটা ও ম্যাক্সমুলারের সাথে। ডেভডিকে নিয়ে এবার কী করা যায় ! শ্যুট করবে, নাকি ক্ষুধার্ত কুকুর জার্মান শেফার্ডরে মুখে ঠেলে দেবে !বেজমেন্টে ভগ্নপ্রায় কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সহসাই ঘটে অঘটন ধরা পড়ে যায় ওরা। ম্যাজিক নাইফ কিংবা ক্লোরোফর্ম টিউব কোনো কাজেই আসে না। কেভিনের লোক ওদের ধরে মুগুরপেটা করে। ডেভিডকে বাঁচাতে গিয়ে প্রায় মেরেই ফেলতে চেয়েছিল লেডি মাপিয়া মিস এলিটাকে। স্প্যানিশ গ্যারোট কৌশলে বাঁচিয়ে দেয় মাইক ও সুমনকে।কিন্তু বাকিদের কী হবে ! এক রুদ্ধশ্বাস টান টান উপাখ্যান। এভাবেই এগোতে থাকে একের পর এক ঘটনা। সাদিকুল বাসার [email protected]
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৯.২/১০ প্রধান চরিত্রঃ সুমন, সায়ান, এমেল, ডেভিড মারটন, মাইক। চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক - টানটান উত্তেজনায় ঠাসা এক রহস্য উপন্যাস যা শেষ না অবধি স্বস্তি নেই। উপন্যাসের শুরুটা চমকপ্রদ। বিখ্যাত লেখকদের লেখায়ও এ গুণটি দেখা যায়। পাঠক কিছু বুঝে ওঠার আগেই বইয়ের কাহিনীতে মগ্ন হতে বাধ্য। যেভাবে চড়াই উৎড়াইয়ের মাধ্যমে গল্পের প্লট এগিয়ে গেছে তা শিহরণ জাগানিয়া। পাঠকের মনোযোগ অন্যদিকে কনভার্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উপন্যাসের শুরুর কয়টা লাইন তুলে ধরছি- "সত্যি, বড় আজব শহর লন্ডন। এই শহরে এসেছে সুমন এখনও মাস পেরোয়নি। এরই মধ্যে বাড়িওয়ালার নোটিশ- মিসেস ম্যালথাম কোনোরকম রাখঢাক না করে সোজা জানিয়ে দিয়েছে, বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে তোমাকে রুম ছাড়তে হবে। কোথায় যাবে জানি না।" এরপরে সুমন কী করেছে, তার কী বাড়িটা সত্যি ছেড়ে দিতে হয়েছে নাকি ম্যালথাম তার ভুল বুঝতে পেরে সরি সুমন বলে থেকে যেতে বলেছে! এরকম এক রহস্যের মধ্যে শুরুতেই পাঠক আটকে যাবে। এরপর পড়তে পড়তে সামনে এগিয়ে যাবে আর জড়িয়ে যাবে ক্রমশ নতুন নতুন রহস্যে। এভাবে পাঠকের সামনে এসে হাজির হবে রহস্যময় পঞ্চাশোর্ধ চরিত্র ডেভিড মারটন। এরপর আসবে নেপালি ছাত্র সায়ান, কিডন্যাপ হতে বেঁচে যাওয়া এমেল এবং এমেলের বন্ধু মাইক। এই চার তরুণ তুর্কীকে নিয়ে উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে আর রচিত হয়েছে রহস্যের জাল। এইসব রহস্য থেকে বের হবার কোনো ফুরসত নেই যেনো পাঠকের। না, মিসেস ম্যালথামের মনে বাঙালি মায়েদের মত অত দয়ামায়া ছিলো না। সত্যি সত্যি সুমনকে বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। বাসার খোঁজে পিকাডেলি লাইনে উঠে টিউবে বসে সাত পাঁচ কত কিছু ভাবছে। তার পাশেই একজন গভীর মনোযোগে বিনে পয়সার পত্রিকা পড়ছে। আর সুমন আড়চোখে দেখছে ঘর ভাড়ার বিজ্ঞাপনটি। এতেই হয়তো বিষয়টি ধরে ফেলেছেন ভদ্রলোক। সুমনকে জিজ্ঞেস করছে, তোমার কী রুম দরকার। ও ইয়েস বলে সুমনও ভদ্রলোকের সাথে নেমে পড়লেন। পাঠক, ইনি সেই ডেভিড মারটন। আশ্চর্য রহস্যময় এক চরিত্র। সুমন মারটনকে ফলো করছে কিন্তু সুমন কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই জিজ্ঞেস করছে- "ডেভিড, আমার সত্যি একটা রুম দরকার। আজকের পরে আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। বড় করুণ শোনাল সুমনের কন্ঠ।" ডেভিড মারটন তখন তাকে বললেন, "ডোন্ট ওয়রি। তোমার ঘর চাই আমার তোমাকে চাই।" মারটনের এই বাক্যটি পড়ে পাঠক আবার একটা ধাক্কা খাবে। আটকা পড়ে যাবে আরেক রহস্যে। শেষ পর্যন্ত সুমন কী ভদ্রলোকের প্রস্তাব মেনে নিবে? নিজের পায়ে কুড়াল মারছে না তো সুমন। এইরকম নানান ভাবনার দোলাচলে পাঠক এগিয়ে যাবে। অনেক ঘুরে তারা একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের সমারোহ নিয়ে বসল। কিন্তু সুমন অনেক চিন্তিত। ঠিকমত খেতে পারছে না। বিষয়টা ডেভিড ধরতে পেরে বলল, "তুমি বুদ্ধিমান কিন্তু কৌতূহলটা মাত্রা ছাড়া। জানো তো ভাবুকদের দিয়ে কিচ্ছু হয়না। ডোন্ট বি সো কিউরিয়াস। বিপদ হতে পারে।" বিপদ হতে পারে! কেন কিসের বিপদ! পাঠক বারবার মুখোমুখি হবে এরকম অদ্ভুত রহস্যের। আর উপন্যাসের কাহিনিও এগিয়ে যাবে তড়তড় করে। রহস্যের বেড়াজাল থেকে সুমনের যেমন নিস্তার নেই পাঠকের দশাও হবে তেমনি। যাই হোক একসময় সুমন বাসার ভাড়া জানতে চাইলে ডেভিড বলে নো রেন্ট! আড়াই তলার বাসায় আধা তলায় তুমি থাকবে। কিচেনে চাল ডাল মজুত আছে ছয় মাস কেটে যাবে। দিনের আলোয় সেখানে যাওয়া বারণ। আগামীকাল সন্ধ্যা ৭ টায় যাওয়ার কথা বলে চোখের পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ডেভিড। পরদিন যথাসময়ে সুমন এসে পৌঁছায়। তার আগে ম্যালথাসের সংগে এক ভয়ানক কান্ড করে আসে। ডেভিডও আসে। গাড়িতে করে নিয়ে আসে বাড়িতে। সুমনকে রেখে তার ফোন নাম্বার নিয়ে এবং চাবি না দিয়ে চলে যায় আর সাবধান করে পুলিশকে(৯৯৯) ফোন না করতে তাহলে বিপদ হতে পারে। রহস্য! রহস্য!! রহস্যের শিরোমনি। ভাড়া লাগবে না, খাবার মজুদ আছে, শুধু হাফ তলা, দিনে নয় রাতে প্রবেশ! পুলিশকে ফোন নয়। বাসার চাবি নয়। সুমন কী কোন কুল কিনারা করতে পারবে এই সব রহস্যের। রাতে নানা রকমের ভুত পেত্নীর কথা তার মাথায় আসে আর ভয়ে কু্ঁচকে যায়। নানা রকম ভুতুড়ে শব্দ কানে আসে। সিধান্ত নেয় ফ্রী বাসায় আর নয় অমনি ডেভিডের ফোন আসে। অবশেষে চাবির হদিশ পাওয়া যায় কিন্তু সে আরেক রহস্য। অনেক কষ্টে সে রহস্যের জট খুললে ডেভিড খুশি হয়। পরেরদিন সে সংগী করে নিয়ে আসে তার মতই অসহায় বিপদাপন্ন নেপালি ছাত্র সায়ানকে। কিন্ত ডেভিড কীভাবে যেনো তা জেনে যায়। রাতের বেলা এই বাড়িতে ঘটতে থাকে অলৌকিক সব শিহরণ জাগানিয়া ঘটনা। একদিন রাতে তারা উদ্ধার করে মাফিয়াদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া স্প্যানিশ কন্যা এমেলকে। যথারীতি এ খবরও ডেভিড জেনে যায়। সময় যত গড়ায় বইয়ের রহস্য যেনো তত বাড়তে থাকে। এ রহস্যের যেনো শেষ নেই। শেষ হইয়াও হইলো না শেষ! এরই মধ্যে সুমন ও সায়ানের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয় এমেলের। তারা বদলা নিতে চায় এমেলের এনিমিদের বিরুদ্ধে। তার আগে অবশ্য বদলে যায় এমেল। ঘটতে থাকে নাটকীয় সব ঘটনা। একদিন রেলস্টেশনে আক্রান্ত হয় এমেল। সুমন সে যাত্রায় তাকে বাঁচায়। প্রতিবেশি বুড়ির ভেপসা গাড়িতে চড়ে রাতের বেলা রেকি করতে বের হয় মাফিয়াদের আস্তানা। সুমন মারাত্মকভাবে জখম হয়। অল্পের জন্য তার জীবন হাতে নিয়ে ফিরে আসে সে যাত্রায়। কিছুদিন পরে ডেভিডের ফোন আসে। চটজলদি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ। আজ রাতটুকু বাড়িতে নয়। ওরা হতবাক। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুতই বেরিয়ে যায়। কিন্তু সুমন তার ব্যাগে ডেবিট কার্ড খুঁজে পায়না। এখন উপায়? সুমনের বুদ্ধিতে কানা খোঁড়ার অভিনয় করে বিনা পয়সায় না হয় বাসে চড়া গেলো কিন্তু রাতের থাকা আর খাবার? এবার বুদ্ধিটা এলো সায়ানের পেট থেকে। সে এক আশ্চর্য ঘটনা। রহস্যটা গচ্ছিত থাক পাঠকের জন্য!! পরদিন তারা ডেভিডের টেক্সট পেয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়িটায় ফিরে আসে। হয়তো সেই সাথে ফিরে আসে বিপদের হাতছানি। ভোররাতে গোঁ গোঁ শব্দ করে আসে এক গাড়ি। জানালার শার্শিতে ছুড়ে মারে এক ধাতব বাক্স। যার ভিতরে থাকে একটা আংটি আর ভয়ংকর কিছু একটা। যা দেখে সায়ান লুটিয়ে পড়ে দরজায়। পরদিন সায়ানের বাজারের ব্যাগের সাথে ফ্রী হিসেবে পায় এক ভয়ানক হুমকি। "মরতে চাও! সবুর করো আমরা আসছি। সিএইচ কাসলে দেখা হবে।" ওদের দুশ্চিন্তায় সময় কাটে। এরই ফাঁকে আরো টেনশন বাড়াতে আসে ডেভিডের টেক্সট। তিনি মাফিয়াদের হাতে বন্দী। নিশ্চয়ই তাকে অনেক টর্চার করছে। বসে থেকে সময় নষ্ট করতে চায় না সুমন। তিনি তাদের বিপদের বন্ধু, তাকে উদ্ধার করতে হবে কিন্তু কীভাবে?? এমেলের এক সাহসী বন্ধু মাইককে এ যাত্রায় সুমনদের সংগে অংশ নেয়। চার বন্ধু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে লন্ডনের উপকণ্ঠে কেন্ট সীমান্তে চিলিংহ্যাম দুর্গের ভূগর্ভস্থ কক্ষে সর্তকতার সহিত ঢুকে পড়ে। কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া কেভিন ও'নেইল জরুরি সভায় ব্যস্ত মিস এলিটা ও ম্যাক্সমুলারের সাথে। ডেভিডকে তারা কী করবে? শ্যুট নাকি ক্ষুধার্ত কুকুরের খাবার ! নিকষ কালো অন্ধকার। বেজমেন্টে ভগ্নপ্রায়। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সায়ান আর এমেল। ম্যাজিক নাইফ কিংবা ক্লোরােফর্ম টিউব কোনাে কিছুই কাজে আসছে না ঠিকমত। কেভিনের লােক ওদের ধরে নির্যাতন করছে। সুমন আর মাইকও বসে নেই। ডেভিডকে বাঁচাতে হবে এই ভাবনা থেকে প্রায় মেরেই ফেলতে চেয়েছিল এলিটাকে। শেষ পর্যন্ত তারা কী উদ্ধার করতে পেরেছিল ডেভিডকে? রুদ্ধশ্বাস, শ্বাসরুদ্ধকর টানটান উত্তেজনায় ঠাসা এক রহস্য উপন্যাস। বইটির ভাষা সহজ সরল সাবলীল। বইটি পড়ে অনেক আনন্দ পেয়েছি। এক বসাতেই বইটি শেষ করতে পেরেছি। বইয়ের কাহিনী, অ্যাডভেন্ঞ্চার, হাস্যরস, আকস্মিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই হাসছি, এই কাঁপছি, এই শিহরিত হচ্ছি আর ফিরে যাচ্ছি বালকবেলায়! এই যে "শেষ না করে উঠতে পারা" এটা কিন্তু কম কথা নয়। বইটিতে লন্ডনের পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা ও জীবনযাপন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। লেখক বইটিতে প্রবাদ বাক্যের যথাযথ ব্যবহার করতে পেরেছেন। লেখকের স্পাই, জলপিপি কিংবা অন্য বইটিতেও অবশ্য এ বিষয়টা লক্ষ্যনীয়। বইটির কিছু রহস্য শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকে গেলো। পাঠক হিসেবে এজন্য আমার আফসোস থেকে গেলো। যেমন- রাতের অলৌকিক ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো না। সুমনদের যখনই ডেভিড মারটনকে প্রয়োজন তখনই তার ফোন হাজির। উপন্যাসের শেষটা খুব তড়িঘড়ি হল। এত সহজে সুমনদের ধরা পড়ার ঘটনা না দেখিয়ে আরো অ্যাডভেনঞ্চার দেখানো যেতে পারত। হতে পারত সুমনরা মাফিয়াদের কয়েকটাকে চিৎপটাং করে বেঁধে রেখেছে! সেক্ষেত্রে লন্ডন পুলিশের আগমন আরো বিলম্বে হতে পারত। ভাষা ভিন্ন, দেশ ভিন্ন, কৃষ্টি-কালচার-সংস্কৃতি ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও মানুষে মানুষে যে বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব এ কথাটি লেখক জোর গলায় বলতে পেরেছেন। যখন এদেশে ধর্মের নামে, ভাষার নামে, সংস্কৃতির নামে, রাজনীতির নামে, ভিন্নমতের নামে, আস্তিক-নাস্তিকতার নামে মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করা হয় তখন আলোচ্য এই বইটিকে মানুষের মাঝে বন্ধুত্বের এই মহৎ সম্পকর্কে গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এজন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই। শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বের জয় হয়েছে, ভালোবাসার জয় হয়েছে, দেশপ্রেমের জয় হয়েছে।। বইটির কাগজ এবং বাঁধাই অনেক উন্নতমানের। বানান বিভ্রাট চোখে পড়েনি। প্রচ্ছদ অনেক সুন্দর হয়েছে। দাম ও সহনীয়। এত সুন্দর করে বইটি পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পাঞ্জেরী প্রকাশনাকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। বইটির বহুল প্রচার ও সাফল্য কামনা করছি। রিভিউদাতাঃ শেখর চন্দ্র বালা পেশাঃ শিক্ষকতা ই-মেইল - [email protected]
চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্কঃ "রস-রহস্য, রোমাঞ্চের ভিড়, এ যেন অরুণ সৃষ্ট এক শ্বাসরুদ্ধকর শিবির"। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির যুগে মানুষ যখন যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই কল্পরাজ্যে ঘুরে আসার ইচ্ছে পূরণ করতে পারছে ঠিক সেই সময়ে লেখনীর মাধ্যমে মানুষকে হাসানো একইসাথে কল্পনার জগতে ভাসানো বড় দুঃসহ কাজ। কেননা চরিত্র চিত্রন এবং ঘটনাপ্রবাহে সামান্য বিচ্যুতিই হতে পারে সেই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু সাহিত্যিকের কলমের ফোয়ারা তো অবাধ্য ঝর্ণার মত। শত বাধা সত্ত্বেও পাঠক হৃদয়ে আছড়ে পরার লোভ তারা সামলে উঠতে পারে না। ঠিক যেমনটি পারেননি কথাসাহিত্যিক অরুণ কুমার বিশ্বাসও। রচনা করেছেন কৌতুকাবহ, রহস্যাবৃত এক অনন্য উপন্যাস "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক"। কসমোপলিটান শহর লন্ডনে বাঙালি যুবক সুমন, নেপালি কিশোর সায়ান, অ্যাংলো-স্প্যানিশ মেয়ে এমেল এবং আফ্রো-ক্যারিবিয়ান ছেলে মাইকের কাকতালীয়ভাবে পরিচয় এবং পরবর্তীতে সখ্যতা গড়ে উঠে। আর্ল-অফ কেন্টের চিলিংহ্যাম ক্যাসলে আস্তানা গাড়া কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়াদের খপ্পরে পরে তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। শার্লক হোমসের অপরিচিত এই শহরে চার তরুণের টিকে থাকার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের পটভূমি। এই বিষাদনগরে নির্ঘুম রাতে সহসাই যদি বাসনা জাগে, এমন এক পৃথিবী ভ্রমণের যেখানে আপনি এডভেঞ্চারাস ও কিছুটা শিহরিত হয়ে প্রেমাকুল আর রসিকতায় বুঁদ থেকে সবশেষে যদি আত্মপ্রত্যয়ী হতে চান, তাহলে "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক" উপন্যাসটিই হবে আপনার সর্বোত্তম সঙ্গী। উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট বাংলার দামাল ছেলে সুমন। অত্যন্ত সাহসী, অদম্য, দ্বিধাহীন সুমন সম্পূর্ণ উপন্যাসজুড়ে বিদেশের মাটিতে বাঙালিদের জন্য সুনাম কুড়িয়ে বেড়িয়েছে। প্রেমিক পুরুষ হিসেবেও লেখকের রংতুলিতে আঁকা সুমন চরিত্রটি মন্দ নয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে থাকাখাওয়ার চিরায়ত সমস্যায় জর্জরিত সুমনের জীবনে দেবদূত হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ডেভিড মারটন সাহেবের। লেখকের সৃষ্ট রহস্যময় চরিত্র ডেভিড সাহেব গল্পের আকর্ষণ জিয়িয়ে রেখে উপন্যাসকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ধুর্ত, ক্ষমতাধর ডেভিড সাহেবও একপর্যায়ে কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়াদের দ্বারা অপহৃত হন। উপন্যাসের অন্যতম শক্তিশালী এক চরিত্র হচ্ছে নেপালি পুঙ্গব সায়ান। একটু ভীতু গোছের সায়ান বেশ রসিকতাপূর্ণ। উপন্যাস পড়তে পড়তে মনের অজান্তেই পাঠকের মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলতেই মূলত লেখক সায়ান চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন। ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে লেখক এক পর্যায়ে এমেল নামের নারী চরিত্রের আবির্ভাব ঘটান। সুশ্রী এমেল খানিকটা মায়াবী যার প্রেমে হাবুডুবু খায় সুমন। তবে তার কার্যকলাপ সুমনের মনে সন্দেহ জাগায়, আসলে এমেল কি তাদের দলে নাকি ড্রাগ মাফিয়াদের দূত। গল্পের একেবারে শেষের দিকে পিটার মাইক চরিত্রের হুট করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া খানিকটা অস্পষ্ট ঠেকেছে আমার কাছে। আরেকটু আগে এই চরিত্রের আগমন ঘটতে পারত, তাতে করে সুমন, সায়ান, এবং এমেলের সাথে মাইকের গড়ে উঠা সখ্যতা যুক্তিযুক্ত হত। তবে লেখক হয়ত গল্পের উত্তেজনা আরোও বাড়িয়ে দিতে মাইককে শেষের দিকে পরিচয় করিয়েছিলেন। উপন্যাসের এন্টাগনিস্ট মিস এলিটা। সম্পর্কে সে এমেলের মা। ভয়ংকর এই মহিলার যে কাউর প্রান নিতে এতটুকুই হাত কাঁপে না। ড্রাগ সাপ্লাই থেকে শুরু করে নারী ও শিশু পাচারে এলিটা সম্পূর্ণ ইউরোপজুড়ে এক প্রলয়ঙ্কারী নাম। তার সহযোগী কেভিন ও মুলার ছাড়াও আছে অসংখ্য গুন্ডা বাহিনী। চিলিংহ্যাম দুর্গ আপাতত তাদের আস্তানা। এছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে আরও কিছু চরিত্র এসেছে যেমন মিসেস ম্যালথাম, মিসেস বারবারা, পুলিশের কমান্ডো ইত্যাদি। প্রয়োজন শেষে আবার হারিয়েও গিয়েছে। উপন্যাসের স্বার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে মনোহর চরিত্র বিনির্মানের উপর। তবে ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে চরিত্র চিত্রনে আত্মদ্বন্দের বিড়ম্বনায় ভোগেন লেখকেরা। কেননা ডিটেকটিভ, থ্রিলার অথবা এডভেঞ্চার ধর্মী উপন্যাস লিখতে গেলে লেখককে একই সাথে অপরাধী হয়ে পরিকল্পনা করে অপরাধটি করতে হয়, নিজেকে বাঁচানোর জন্য লুকাতে হয় আবার একই সাথে গোয়েন্দা হয়ে ঘটনার প্রতিটি কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজে রহস্যের জাল ভেদ করতে হয়। কিন্তু লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের হাতে চিত্রার্পিত উচ্ছ্বল প্রাণের স্পন্দনগুলো দীপ্তি হয়ে মুক্তো ছড়িয়েছে সম্পূর্ণ উপন্যাসজুড়ে। রহস্যাবৃত ঘটনাপ্রবাহ উপন্যাসের স্বার্থকতার আরেকটি মানদন্ড। চিলিংহ্যাম ক্যাসলের মাফিয়াদের সাথে লড়তে গিয়ে চার তরুন কি সবশেষে সফল হয়েছিল কিনা, চার তরুণের মধ্যে কেউ বেচে ফিরেছিল কিনা, ডেভিড মারটনের সত্যিকারের পরিচয়, ইত্যাদি রহস্য লেখক অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে গেঁথে রেখেছেন গল্পের পরতে পরতে। শক্তিশালী চরিত্র এবং বাধ্যকারী ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করা বাংলা সাহিত্যে স্বার্থক উপন্যাসের সংখ্যা নেহাত কম নয় তবে সকল উপন্যাস ক্লাসিকাল হওয়ার মর্যাদা পায় না। কেননা কালোত্তীর্ণ হতে গেলে উপন্যাসের তিন উপাদান যথা ১) বিনোদনমূলক, ২) উপলব্ধিমূলক এবং ৩) তথ্যসূচক উপাদানের যথাযথ সমন্বয়ও প্রয়োজন। লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক" উপন্যাসে এই তিন উপাদানের ব্যবহার আমার কাছে যথার্থই ঠেকেছে। রহস্যের বাতাবরণ, ভয়ানুভূতি, রোমাঞ্চ কিংবা মজার মজার শব্দ (হাসি+কান্না=হান্না, আলু+লুচি=আলুচি) জুড়ে দিয়ে লেখক আমাদের যেমন বিনোদিত করেছেন একইসাথে গল্পের এক পর্যায়ে স্মৃতিকাতর হয়ে স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধও জাগ্রত করেছেন। লন্ডনের নিয়মনীতি, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির সাথে বাংলাদেশের তুলনা করে আমাদের সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কখনো কখনো ইতিহাস পর্যালোচনা করে বাংলার নবাবদের ভুল চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন। সবশেষে বাঙালি দামাল ছেলেদের সাহসিকতার প্রশংসায় মুখর হয়ে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটিয়েছেন লেখক। তাছাড়া রসিকতার ছলে লন্ডনের জীবনযাত্রা, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার চেষ্টায়ও সফল হয়েছেন তিনি। আশা করছি তার উপন্যাস "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক" কালোত্তীর্ণের পথে এগোবে। এতক্ষণে হয়ত ভাবছেন, উপন্যাসের নামকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা। লেখক নামকরণের ক্ষেত্রে তেমন রহস্যের আশ্রয় নেননি। আর্ল-অফ কেন্টের চিলিংহ্যাম দুর্গকে ঘিরেই উপন্যাসের যত রহস্য, রোমাঞ্চ আর আতঙ্ক আবর্তিত হতে থাকে। সকল চরিত্রের উর্ধ্বে উঠে এই স্থানটি যেহেতু উপন্যাসের ভাবার্থকে সম্পূর্ণরূপে ধারণ করে সেহেতু উপন্যাসের নামকরণ স্থান ভিত্তিক হওয়াই যথার্থ হয়েছে। প্রমথ চৌধুরীর দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগের বিরুদ্ধে শুরু করা আন্দোলনের স্বার্থকতা পেয়েছে অরুণ কুমার বিশ্বাসের "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক" উপন্যাসে। সম্পূর্ণ গল্পের শব্দচয়ন ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং সহজবোধ্য। ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার অনেকের কাছে বিরক্তিকর ঠেকলেও আমার মনে হয়, লন্ডন শহর ভিত্তিক রচিত উপন্যাসে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার প্রাসঙ্গিক। তাছাড়া ইংরেজিয়ানের যুগে পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার এ-এক অভিনব কৌশল। অনেক ঔপন্যাসিক ফিকশনাল উপন্যাস তৈরির জন্য আশ্রয় নিয়ে থাকেন টাইম-ট্রাভল, ম্যাটেরিয়ালকে ডিম্যাটেরিয়াল করার মত অবাস্তব সব কল্পকথার। কিন্তু লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাস সত্যঘটনা নির্ভর গতানুগতিক গুপ্তচারিতামূলক কিংবা ফিকশনাল গল্পগুলোর বাইরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাস্তবসম্মত কল্পকাহিনীর। এই রসিকতাপূর্ণ, গুপ্তচারিতা মিশ্রিত সাহিত্য সাগরে অবগাহনের জন্য আপনার বাংলা সাহিত্যে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের প্রয়োজন নেই। জীবনের এ-পর্যায়ে, সাহিত্য অঙ্গনের এক অভিনব রস আস্বাদনের অভিপ্রায় থেকে থাকলে উপন্যাসটি একবার হলেও পড়ে দেখবেন। কথা দিচ্ছি, আশাহত হবেন না। শেষ করার আগে বইয়ের বাঁধাই ও প্রচ্ছদ নিয়ে কটি কথা না বললেই নয়। তৈলচিত্রের প্রচ্ছদ বরাবরই আমার কাছে চমৎকার লাগে। বাঁধাই ভালো, মজবুত। কাগজের মানও ভালো। তবে মুদ্রণজনিত দু'য়েকটি ভুল দৃষ্টি এড়ায়নি। বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে ১৬ থেকে ১৭ পৃষ্ঠার মাঝে ৩৩ থেকে ৪৮ তম পৃষ্ঠা ঢুকে গিয়েছে। সম্ভবত আমার বইয়েই এই ভুলটি হয়েছে। ঔপন্যাসিক সম্পর্কে কিছু কথা বলি। ঔপন্যাসিকের "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক" উপন্যাসটি ইতিমধ্যেই বেশ সাড়া জাগিয়েছে। ঔপন্যাসিকের রচিত আলিম বেগের খুলি, স্পাই, জলপিপি উপন্যাস পড়েছি। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। "স্পাই" উপন্যাসের জন্য ইতিমধ্যেই লেখক এসিআই-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরষ্কার-২০১৮ তে ভূষিত হয়েছেন। ইংরেজি এবং জাপানি ভাষার উপর লেখকের দখল আছে বেশ। শুনেছি লেখক বড্ড ভ্রমণপিপাসু মানুষ, হয়তো লন্ডন, জাপান ভ্রমণের সুযোগও হয়েছিল উনার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্বশীল পদে থেকেও নিয়মিত পত্রিকায় লেখালিখি করা একই সাথে বই লেখা সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে সকল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। লেখকের সবচেয়ে বেশি আগ্রহের জায়গা গোয়ান্দা এবং এডভেঞ্চারধর্মী গল্প। এপার বাংলায় এধরনের বইয়ের সংখ্যা অতি নগন্য। আশাকরি লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের "জলপিপি", "কফিমেকার", "আলিম বেগের খুলি", " চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক", "অথই আঁধার", "স্পাই" এবং নতুন তৈরি করা প্লাটফর্ম "দ্য ডিটেকটিভস" সেই অপূর্ণতা ঘোচাবে। বাংলাসাহিত্য নিঃসন্দেহে আরেকজন কালজয়ী লেখক পেতে যাচ্ছে। লেখকের জন্য শুভকামনা। ধন্যবাদ। রিভিউদাতার পরিচয়ঃ প্রান্ত বনিক মার্কেটিং বিভাগ (৪র্থ বর্ষ) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
"বইবাজার ডটকম বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা" "চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক, কিশোর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস, পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স লি।" (হার্ডকভার) লেখকঃ অরুণ কুমার বিশ্বাস। ISBN: 9789846342901 রেটিংঃ ৮.৫/১০ রিভিউ লেখকঃ বদরুদ্দীন আর-রাব্বানী। প্রতিষ্ঠানঃ মারকাযুল এহসান, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা। বর্ষঃ উচ্চ মাধ্যমিক (সমমান) ________________ 'চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক', তরুণ কথাসাহিত্যিক অরুণ কুমার বিশ্বাসের কিশোর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। উপন্যাসের মূল আকর্ষণ হচ্ছে রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার। কিন্তু উপন্যাসটিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে প্রাত্যহিক জীবনাচার, নারী-পুরুষের একে অপরকে একান্ত আপন করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ প্রেম-ভালোবাসা। উপন্যাসের প্রতিটি নিয়ম মেনে লেখা অত্যন্ত দুরূহ কাজ, এই দুরূহ কাজটিই কতো সহজে উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখার সাথে আমার এই প্রথম পরিচয়, কিন্তু তার বর্ণনা-শৈলি, শব্দের গাঁথুনিতে দারুণ অভিভূত হয়েছি। উপন্যাসটিকে কেবল উপন্যাস হিশেবে বিবেচনা করলে লেখকের সৃষ্টিকর্মকে বড্ড খাটো করা হবে। লেখক এখানে কেবল একটি গল্পই বলেননি, অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বলে দিয়েছেন আপতিত বিপদ মোকাবেলার উপায়। কীভাবে বিষণ্ণতাকে পায়ে ঠেলে জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে হয় এই সবক দেয়ার চেষ্টা করেছেন, এবং অত্যন্ত সফলভাবে এর ফলাফলও দেখিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাসের যে দিকটা আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে, তা হলো লেখকের গদ্যশৈলী; প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। সূচনাতেই কেমন জাদুকরী বয়ান- 'সত্যি, বড়ো আজব শহর লন্ডন'। অদ্ভুত তো! লন্ডন আবার আজব হতে যাবে কেন? এমন দারুণ বাক্যের সমাহার একরকম তাড়িয়ে উপন্যাসের শেষপর্যন্ত নিয়ে গেছে। এর বিষয়বস্তু কেবল ড্রাগ মাফিয়াদের প্রতিরোধের রোমাঞ্চকর বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এতে লেখক তুলে এনেছেন লন্ডনের পুলিশ ও পরিবহন খাতের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশকে। প্রত্যেক লেখকের মননশীলতার ভিত্তিই হলো দেশপ্রেম, তাঁর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবক্ষয়ে লেখকের হৃদয় কুঠুরিতে যে বেদনা গুমরে মরছে, তা-ও অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ব্যক্ত করেছেন। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির প্রতি লেখকের দুর্নিবার আকর্ষণও উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। লেখকমাত্রই কোনো এক চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্প বয়ান করেন, কিন্তু লেখকের কুশলতায় তা সার্বজনীন হয়ে ওঠে; কেননা মিসেস ম্যালথাম যখন সুমনকে তার বাসা থেকে বের করে দেয়, তখন সুমনের সঙ্গে আমাদেরও দারুণ এক বেদনা গ্রাস করে। জীবনের ঘূর্ণনটা আমাদের কাছে রহস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেই রহস্যের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে প্রেম, বিরহ, সুখ, দুঃখ, তুমুল হাসিঠাট্টা আর প্রগাঢ় বিষণ্ণতা। গল্প এগিয়ে যায়, আর অবারিত হয় রহস্যের দুয়ার। আমরা ক্রমেই ঢুকে যেতে থাকি দুর্লঙ্ঘ প্রাচীরঘেরা রহস্যের অন্তঃপুরে। ভাবনার অথৈ সাগরে যখন সুমন হাবুডুবু খাচ্ছে যে, এই ভিনদেশে সে কোথায় গিয়ে উঠবে, মাসের মাঝামাঝি রুমই বা কোথায় পাবে? ঠিক তখনই ভাসমান খড়কুটোর মতো পত্রিকার বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ে, ক্রমে সেটা মরু-বিয়াবানে নিঃস্ব পথিকের মাথার ওপর মেঘখণ্ডের ছায়ার মতো হয়ে ওঠে। ডেভিড মারটনের অনুকম্পার সঙ্গে অরুণ কুমার বিশ্বাসের জাদুকরী বর্ণনায় সুমনের সঙ্গে আমরাও দ্রবীভূত হই। ধীরে ধীরে যেন আমরাও হয়ে যাই উপন্যাসের চরিত্র। গল্পটা এরকম- 'সুমন (হিমাংশু শেখর দত্ত) যে কিনা মূলত বাংলাদেশ থেকে বিলেতে লেখাপড়া করতে এসেছে, ঘটনার ঘনঘটা আর ভাগ্যের ক্রমপরিবর্তনে সে দিশেহারা হয়ে যায়। ডেভিড মারটনের আড়াই তলা বাড়িতে বিচরণের অধিকার তার আছে। কিন্তু চাবি? বাড়ি থেকে বেরুলে তো ঢোকার পথ বন্ধ! তাছাড়া ডেভিড মারটনের কড়া হুঁশিয়ারী- নো কোয়েশ্চন, নো কিউরিওসিটি! শুরু হয় রহস্য! অদ্ভুত কৌশলে বুদ্ধির পরীক্ষায় উৎরে যায় সুমন। সময়ের পরিক্রমায় নেপালি যুবক সায়ানের সঙ্গে পরিচয়, যে কি না মূলত লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরিও করতো, জনৈকা শ্বেতাঙ্গীনীকে এক্সট্রা খাতির করতে গিয়ে চাকরিটা খোয়ায়। সুমন তাকে মিস্টার ডেভিডের আড়াই তলা বাড়িতে আশ্রয় দেয় আর ভাবে, মিস্টার ডেভিড কী বলবে? ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে শুরু হয় সায়ান আর সুমনের দারুণ মেলবন্ধন। প্রতিবেশি বিধবা মিসেস বারবারার সঙ্গে দারুণ খাতির জমে সায়ানের। সুখ-দুঃখের আদানপ্রদান করে। একদিন গভীর রাত, সুমন ডুবে গেছে ঘুমে, কিন্তু সায়ানের চোখে ঘুম নেই, উবে গেছে। কীসের যেন শব্দ, এইতো একটু দূরে। বুকে ঢিপঢিপ, দারুণ ভয়। চূড়ির রিনিঝিনি, হঠাৎ অজানা রহস্যময়ীর শব্দে জ্ঞান হারায় সায়ান। তারপর চুপচাপ, যেন ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা তাকে পেয়ে বসেছে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু গল্পের মোড় পাল্টে যায় এক গভীর রাতে বাহিরে মেয়েলি চিৎকার শুনে। সুমন উঠে পড়ে চিৎকারের উৎস অনুসন্ধান করতে, সায়ানের মনে ভয়, জড়তা, ইতস্ততবোধ। তবু সেও বের হয়। উদ্ধার হয় এমিল... কেন এমিল দিগন্তব্যাপী চিৎকার করে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমরা ঢুকে যাই গল্পের গভীরে। সম্পূর্ণ অচেনা জগত আমাদের চোখে ভাসে। আমাদের ভাবতে কষ্ট হয় যে, একজন মা কীভাবে তার কলিজার টুকরা মেয়েকে বিক্রি করে দিতে পারে? কিন্তু অরুণ কুমার বিশ্বাস তাঁর উপন্যাসে আমাদের বলেন যে, এটাই জীবন! বহুমাত্রিক চাহিদার নিঠুরতায় এখানে অসম্ভবও হয়ে ওঠে সম্ভবের চেয়েও ধ্রুব সত্যের মতো। স্বার্থের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে পারিবারিক বন্ধন, মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা। . এমিলকে ঘিরে সুমন ও সায়ানের আনন্দ দ্বিগুণ হয়। খুনসুটি, গোপন ভালোবাসা আর চরম উত্তেজনার ভেতর দিয়ে স্রোতস্বিনীর মতো তরতর করে বয়ে যায় গল্প। পদে পদে শত্রুর ভয় আর ডেভিড মারটনের কড়া হুঁশিয়ারীতে তারা ঘরের ভেতরেই থাকে, বিনা প্রয়োজনে বের হয় না। একদিন এমিলের প্রচণ্ড জেদে সুমন সায়ানের সঙ্গে তাকে বেরুতে দেয়। তারপর... সুমন ক্লাশ করে বাসায় ফিরতে গিয়ে রেলস্টেশনে মুখোশ পরা দুজন লোককে উপস্থিত জনতাকে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে, অন্যদিকে ট্রেন আসছে আর এমিল নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। হায়, লোক দুটো তো এমিলের দিকেই যাচ্ছে, এইতো ট্রেন, ওরা এমিলকে ধাক্কা দিলেই তো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তার দেহ। সুমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়ে দেয় এমিলকে। শত্রুপক্ষ বিভিন্নভাবে ভয় দেখাতে থাকে, কখনো রক্তে লেখা চিঠি ও মানুষের কান কেটে, কখনো অন্য উপায়ে। শুরু হয় অভিযান, চিলিং হ্যাম দুর্গে হানা দেয় সুমন, সায়ান ও এমিল। কিন্তু অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবারও এমিলকে বাঁচাতে গিয়ে মারাত্মক আহত হয় সুমন এবং তারা ফিরে আসে। . ডেভিড মারটন খুবই রহস্যময় লোক, তাকে কিছুই বলা যাবে না। তার শান্ত অথচ কঠিন কথা 'নো কোয়েশ্চন, নো কিউরিওসিটি!' কাকতালীয়ভাবে যখনই সুমনের তাকে প্রয়োজন পড়ে ঠিক তখনই তার সন্ধান পায়, কখনো কলে আবার কখনো ইনবক্সে। এমিলের আন্তরিক সেবা-শুশ্রূষায় সুমন স্বাভাবিক, আবারও আগের মতো। হঠাৎ ডেভিড মারটনের ইনবক্স, কড়া নির্দেশ আজ রাত বাহিরে কোথাও কাটাতে হবে। বিপদ আছে। অরুণ কুমার বিশ্বাস এই জায়গায় দেখিয়েছেন দারুণ মুন্সিয়ানা, স্বভাবতই পাঠক রহস্যের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে ক্লান্ত, রহস্যের লাগাতার আলাপ বেসুরো, একঘেয়ে মনে হচ্ছে, হয়তো কেউ ভাবছেন বইটা রেখে একটু হেঁটে চা-কফি খেয়ে আসি। ঠিক তখনই অরুণ কুমার বিশ্বাস গল্পের মোড় পাল্টে দিলেন, পাঠককে ফেলে দিলেন দারুণ উৎকণ্ঠায় । ডেভিড মারটনের সতর্কবার্তায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া সুমন, সায়ান, এমিল আপাতত রাতটা কাটানোর জন্য ব্রিটিশ সুপার শপ টেসকোতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু শপের লোকেরা বুঝে ফেলে কারা যেন রয়ে গেছে ভেতরে, শুরু হয় লুকোচুরি। ওরা এদিকে আসে তো সুমনরা অন্যদিকে লুকিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ইঁদুর ভেবে ওরা চলে যেতে বাধ্য হয়, অন্যদিকে সুমন, সায়ান, এমিল মনের আনন্দের রকমারি খাবারের রাজ্যে নির্ভয়ে রাত্রি কাটিয়ে দেয়। ওই রাতেই ঘটে অঘটন, ডেভিড মারটনের আড়াই তলা বাড়িতে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়, মিস্টার ডেভিড সতর্ক না করলে এতোক্ষণে সুমন, সায়ান, এমিল পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। ডেভিড মারটনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় সুমনদের মাথা নুয়ে আসে। ইতোমধ্যে একদিন সুমনের ফোনে মেসেজ আসে, ডেভিড মারটনকে অপহরণ করা হচ্ছে। সুমন ভাবে ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামা সহজ নয়, এতে চাই মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া তরুণদের। একবার ওদের ডেরা থেকে ফিরে আসলেও এবারে ওরা ছেড়ে কথা বলবে না। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় অকুতোভয় তরুণ মাইক। আবারও চিলিং হ্যাম দুর্গে অভিযানে নামে চার সাহসী তরুণ। বিপত্তি বাঁধল খাল পেরুনো নিয়ে, কিন্তু মাইক এক্রোব্যাটদের মতো গাছের ডালে ঝুলে লাফিয়ে পড়ে ওপর পাশে আর শত্রুদের লুকোনো গাছের গুঁড়ি এগিয়ে দেয়, ওরা গাছের গুঁড়িকে সিঁড়ি হিশেবে ব্যবহার করে খাল পার হয়। বেজমেন্টের ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই ধরা পড়ে ওরা, নিজেদের বাঁচাতে ক্লোরোফোর্ম ব্যবহার করলেও হিতে বিপরীত ঘটে। তুমুল উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে ওরা উদ্ধার করে ডেভিড মারটনকে! . উপসংহারঃ 'চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক' উপন্যাসে মূল চরিত্র ছাড়া পার্শ্বচরিত্র হিশেবে কিছু চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন ঔপন্যাসিক। মিসেস ম্যালথাম, বারবারা, এলিটা, কেভিন, ম্যাক্স, এলিজাবেথ, মিহির, প্রক্টার, অলিভিয়া, গ্যাম্বল- এই বহুমাননিক চরিত্রগুলো উপন্যাসকে আকর্ষণীয় এবং সুপাঠ্য করে তুলেছে। সুমনের সাহস, সায়ানের উপস্থিত বুদ্ধি, মিস্টার ডেভিডের রহস্যময়তা, পিটার মাইকের অকুতোভয় সাহস এবং নায়িকা হিশেবে সৃষ্ট এমিল-ই গল্পের প্রাণ। সর্বোপরি 'চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক' একটি দারুণ রহস্য উপন্যাস। লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের জন্য অশেষ শুভকামনা রইল।
উপন্যাস-চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক লেখক-অরুণ কুমার বিশ্বাস "নো কিউরিওসিটি, নো কোয়েশ্চেন" ডেভিড মারটনের বলা এই কথাটি একদম কানে লেগে আছে এখনো। উপন্যাসে তিনি কিউরিওসিটি দেখাতে বারণ করেছেন কিন্তু পাঠকদের তো কিউরিওসিটি থাকবেই। তাই অনেক কথা অজানা থেকে গেছে বলে আফসোস থাকবে। তবে কিছু কিছু কথা আছে যা বলাও যায় না। আর যা বলে ফেললে পূর্ণ মজাটা থাকে না। এমনই কিছু বলা না বলা কথা আর রহস্য দিয়ে সাজানো হয়েছে উপন্যাস "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক" প্রথমেই লেখককে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে হবে যে তিনি বাংলাদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা টেনেছেন। বিশেষ করে ডেভিড মারটন বাংলাদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে আমাদের স্বাধীনতার কথা টেনেছেন। আর উপন্যাস শেষ করা হয়েছে মূল চরিত্র সুমনের মাধ্যমে এবং সেখানেও ত্রিশ লাখ শহীদের কথা বলে শেষ করা হয়েছে। মূলত আমি এই ধরনের সাহসী অভিযানের উপন্যাস পড়তে খুবই পছন্দ করি। পছন্দ করি ভ্রমণ উপন্যাস পড়তেও। আর লেখক এই উপন্যাসে অভিযান এবং ভ্রমণের ছোঁয়াও দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি উপন্যাসের বিভিন্ন পর্যায়ে লন্ডন শহরের দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনা যেকোনো মানুষকে লন্ডনে ঘুরতেও সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস করি। লন্ডন শহরের চারিপাশ যেন একদম চোখের সামনে ফুটে উঠেছে তার বর্ণনায়। বাস, ট্রেন কিংবা টিউব সবকিছুতে ঘোরাঘুরি করা আর টিকেট কাটা থেকে শুরু করে সবকিছু জানিয়েছেন। কোথায় কোন খাবারের দোকান আছে তাও জানা হয়ে গেছে। কোথায় শপিং মল আছে তা জেনেছি। কোথায় ডেবিট কার্ড আর কোথায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয় তা জানা গেছে। ছাত্রদের জন্য আলাদা টিকেটের ব্যবস্থার কথা জানা গেছে তার উপন্যাসে। শহরের আইন শৃঙ্খলা বা মানুষের নিয়ম মেনে চলার বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার উপন্যাসে। আর সেখানের পুলিশও তৎক্ষনাৎ কোনো ঘটনা ঘটলেই চলে আসে তা বোঝা যায়। এক মহিলা সায়ানকে বর্ণবাদী কটুক্তি করায় ৯৯৯ এ কল দিলে তারা হাজির হয়ে ধরে নিয়ে যায় তাকে। জানা যায় নানা ইতিহাস সম্পর্কেও। আর বিশেষ ভাল লেগেছে শীতকালে ওদের দেশে তুষারপাতের ঘটনার বর্ণনা পড়ে। দারুণ লেগেছে ওদের উইকেন্ড কাটানোর মুহুর্তের কথা শুনে। তবে বাংলাদেশীদের প্রতি বৃটিশদের বিরূপ আচরণের কিছু খন্ডচিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। তারা বাংলাদেশের মানুষদের কাজের জন্য ব্যবহার করে আর প্রয়োজন পড়লেই গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। ইচ্ছে হলে জেলে ঢুকিয়ে জেলের ভাত খাওয়াতে কার্পন্য করে না তারা। তবে সেদেশ আবার জেলে থাকার জন্য দারুণ। জেলে থাকা মানে দারুণ ভাল থাকা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুমনকে তার বাড়িওয়ালা বিনা কারণে ঘরছাড়া করে। পাশাপাশি তার সহযোগী সায়ানকে চাকরিচ্যুত করে তুচ্ছে কারণে এই বৃটিশরা। তাদের কর্তৃক ২০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করার গল্পও বলেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে উপন্যাস পড়ে মনে হচ্ছিল যেন কোনো এক সত্য ঘটনার গল্প শুনছি কারো কাছে। কিছু কিছু বুদ্ধিভিত্তিক বিষয় ফুটে ওঠে উপন্যাসে। বিশেষ করে ডেভিড মারটনের বাসায় সুমনের চাবি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটা রোমাঞ্চিত করেছে আমাকে। চরিত্র বিশ্লেষণে আসলে প্রথমেই বলতে হবে ডেভিড মারটনের কথায়। একজন রহস্যময় মানুষ। যার কোনো কিছুই বোঝা যায় না। তার পুরো চরিত্রটাই অজানা থেকে যায়। তিনি কি করেন, সারাদিন কোথায় থাকেন কিছুই জানতে বুঝতে সক্ষম হয় না কেউই। বিনা কারণে নিজ উদ্যোগে নিজের বাড়িতে জায়গা দেয় সুমনকে। সুমনকে তার নিজের ছেলের মতো মনে করে জায়গা দেয় সে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তার চিন্তাশক্তি এতোটাই প্রখর যে সুমনের চেহারা দেখেই বুঝতে পারে যে তার সাহায্য দরকার, আর এটাও বুঝতে পারে যে সুমন তার ক্ষতি করবে না। তাই তো সুমনকে খাদ্যসামগ্রী সমেত বাড়ি দিয়ে দেয় আর সাথে ক্রেডিট ভাউচারও। তবে আপত্তি একটাই "নো কিউরিওসিটি, নো কোয়েশ্চেন" আর কিউরিওসিটি কেনই বা দেখাতে হবে। তা দেখানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। যখন তাকে প্রয়োজন তখন দেবদূতের হাজির হয়ে যান অথবা ফোন করেন। আর সুমন একে একে সায়ান আর এমেলকে জায়গা দিলেও কিছুই বলেন না ডেভিড মারটন। বরং ওদের সাহায্য করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তিনি। তবে তিনি সবকিছুই আগে জানতে পারেন তিনি। তাই বাড়িতে আগুন লাগার বিষয়টা আগে জানতে পেরে নিরাপদে সরাতে সক্ষম হন সুমন, সায়ান আর এমেলকে। এবার আসি সুমনের প্রসঙ্গে। সুমন বাংলাদেশের ছেলে, পড়ালেখা করতে যায় লন্ডনে। সেখানে গিয়ে থাকা নিয়ে হয়ে যায় বিশাল সমস্যা। কারি রান্নার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বাড়ি ছাড়তে হয় তার। কালক্রমে দেখা হয় ডেভিড মারটনের সাথে। উঠে পড়ে তার ভূতুড়ে বাড়িতে। এই বাড়ি ঘিরেই যত কাহিনী শুরু হয়ে যায়। আস্তে আস্তে তার সাথে এসে যুক্ত হয় সায়ান আর এমেল। সুমন নিরেট একটা ভাল মনের মানুষ। তা নাহলে এক দেখায় শুধু কাঁদতে দেখেই সায়ানকে বাড়িতে নিয়ে আসে! তাও আবার ডেভিড মারটনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও। একইভাবে বাহিরে হট্টগোল টের পেয়ে বের হয়ে দেখা হয়ে যায় এমেলের সাথে। এমেলকেও জায়গা দেয় সেই একই বাড়িতে। আর সুমন ছেলেটা ঢের সাহসী, নাহলে সুদূর বাংলাদেশ থেকে গিয়ে মাফিয়া গ্যাং ধ্বংস করার মিশনে দলনেতা হন! আসলে আমাদের রক্তে যে সংগ্রাম লেখা সুমন তারই একটা প্রতিচ্ছবি। সুমন অনেক দুরবুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি সম্পন্ন একটা ছেলে। তবে কিছুটা রাগও আছে তার। মাঝেমধ্যে রাগ দেখায় সায়ান এবং এমেলের সাথেও। তবে ছেলের মনে তো প্রেমও আছে। সে প্রেমে পড়ে যায় এমেলের কিন্তু বলে না কিছুই! না বললেও কিছু আচরণ ঠিকই প্রকাশ করে দেয় সবকিছু। ভালবাসা কি আর এমেল স্প্যানিশ তা মানবে না। এমেলের প্রতি তার বিশেষ একটা দেখভাল দেখা যায়। বিশেষ করে টিউব স্টেশনে এমেলের উপর হামলা হবার আশংকায় নিজের জীবন বাজি রাখেন তিনি। সায়ান ছেলেটা নেপালের হলেও মা বাংলাদেশী হওয়ায় মিলে যায় সুমনের সাথে। কোন এক মেয়েকে চিজ বাড়িয়ে দেয়ায় চাকরি হারায় সে। সেই কারণেই দেখা হয়ে যায় সুমনের সাথে। সুমন তাকে ডেভিড মারটনের বাড়িতে নিয়ে গেলে সুমনের একা থাকার কষ্ট দূর করেন তিনি। সায়ান আবার রান্নায় পটু। সুমন এই ব্যাপারে দারুণ নিশ্চিন্ত হিয়ে যান সুমনকে পাওয়ার পর। সায়ান আবার ভীতুও আছেন কিছুটা। ডেভিড মারটনের বাড়িতে এসেই ভয় পেয়ে একদম সে কি অবস্থা। ভয়ে যে অজ্ঞান হয়ে যায় তা ঠিক করতে সুমনের বেগ পেতে হয়ম আর এর ফলাফল স্বরুপ তাদের দুজনের একত্রে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে হয়। আর সেই চিলিং হ্যাম দুর্গে গিয়েও তার একই অবস্থা। পরিখা পার হতেই তো বিরাট কান্ড হয়ে যায় তার। আর শত্রুদের হাতে ধরা পড়ার পর তো কথাই নেই। একদম নাকের জ্বলে চোখের জ্বলে হয়ে যায় সায়ান। সায়ান শুধু রান্নায় পটু নয়। ছেলেটা অন্যান্য কাজেও পারদর্শী। ভাল বাইক চালাতে পারে, এমনকি মেকানিক কাজেও ভাল সে। পাশের বাড়ির মহিলার ভেসপা ঠিক করে ফেলে। সায়ানও কিছুটা দুর্বল হয় এমেলের উপর। তাই ভেসপায় এমেলের সুমনের কোমড় ধরার বিষয়ে আপত্তি তোলেন সে। এবার বলা যাক এমেলকে নিয়ে। এমেল চরম নির্যাতনের শিকার একটি মেয়ে। যে কিনা নিজেই চেনে না তার বাবা কে! আর তার নিজের মা তাকে বিক্রি করে দিতে চায় ক্যারিবিয়ান মাফিয়াদের কাছে। এমন অবস্থায় রক্তাক্ত হয়ে এসে পড়েন সুমনদের কাছে। সে আসার পরে আলাদা একটা আবহ তৈরি হয় তিনজনের মাঝে। তিনজন মিলে একটা দারুণ সংসার সাজিয়ে ফেলে তারা। সায়ানের সাথে সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে এমেলের। সুমনের সাথে হয় মনমালিন্য। কারণ সুমন আর এমেল যে একে অপরকে ভালবাসে তা বুঝতে বাকি থাকে কারো। মাঝেমধ্যে রাগও করে সুমনের উপর। একবার তো রাগ করে চলেই যেতে চায় বাড়ি ছেড়ে। সুমন অবশ্য বিপদ বুঝতে পেরে এমেলকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বরফ গলাতে পারে। মাইক হচ্ছে এমেলের বন্ধু। সে সাহসী একটা ছেলে। সুমনদের চিলিং হ্যাম দুর্গে অভিযানের মূল টুইস্ট ছিলো সে। তার সাহসেই অনেকটা অনুপ্রেরণা পায় ওরা তিনজন। কেভিন হচ্ছে মাফিয়া দলের প্রধান আর এলিটা সেই ভয়ংকর মহিলা যে কিনা এমেলের মা। তারা ধরে নিয়ে যায় ডেভিড মারটনকে। কেভিন সাহেব যতই খারাপ হোক না কেন পুলিশকে যে বেদম ভয় পায় তা বুঝতে বাকি থাকে না। আর এই মহিলা এত বাজে তা দেখে সকলের তার প্রতি ঘৃণা জন্মাবে। নিজের মেয়ের উপর এমন নির্যাতন চালায়, আর নিজের স্বামীকে মেরে তার উপরে নুনও ছিটান। যাকে বাংলাদেশে বলে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। প্রথমবার চিলিং হ্যাম দুর্গে অভিযান চালায় মাইককে ছাড়াই। সেবার সুমন ক্ষত হয়ে ফেরে। কিন্তু পরেরবার যখন অভিযানে যায় তখন নিয়ে ফেরে বিজয়। অন্ধকার সেই দুর্গের অভিযান কি দারুণ, কি চরম উত্তেজনাকর তা যারা বইটি পড়েছে তারাই বুঝবে। তারা হয়তো নিজেরা বিপদে পড়তেই পারতো কারণ তারা ধিরা খেয়ে গিয়েছিলো শত্রুদের কাছে। ধরা খেয়ে সায়ানের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু ভয় পায় না সুমন, মাইক আর এমেল। শত্রুদের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে যায় ডেভিড মারটন সহ ওরা সবাই। এক সময় বুঝে গিয়েছিল সব শেষ। কিন্তু সময় মতোই পুলিশ এসে যায় সঠিক সময়ে, লেখকের ভাষায় বাংলা সিনেমার মতোই। হিরো বনে চলে যায় ওরা। মুক্ত পায় ডেভিড মারটন আর এমেল ফিরে পায় তার বাবাকে অর্থাৎ ডেভিড মারটনকে। এটাই উপন্যাসের বিশাল টুইস্ট। একদম শেষে গিয়ে জানা যায় এই বিষয়টি। এমেল না জানলেও জানতেন ডেভিড মারটন। তবে জানা যায়নি তাদের পুরনো স্মৃতির কথা। আর ডেভিড মারটন জানতেন বলেই হয়ত এমেলকে তার বাড়িতে জায়গা দেয়ার কারোনে সুমনের উপরে রাগ করার বদলে সুমনকে সাহায্য করেন। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, অভিযানের জায়গা একদমই ছোট হয়ে গিয়েছে। এই জায়গাটা আরো বড় আশা করাই যায়। কারণ অন্য কথা এতো বর্ণনাসংবলিত থাকায় অভিযান কম আশা করবে না কেউই। তবে আক্ষেপ থেকে যাবে এমেল আর সুমনের ভালবাসার কি পরিণতি হয় সেটা জানার জন্য। বেচারা সায়ানও কষ্টে ভুগবে কারণ মনে মনে সেও তো একটু দুর্বল হয়েছিল এমেলের প্রতি। রহস্য উদঘাটন হয়নি ডেভিড মারটন সাহেবের বাড়িতে ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হবার আবহ। কে শব্দ করতো, কে কান্না করতো এসব প্রশ্ন অজানা থেকে একটু মনে আক্ষেপ থাকবে। কিছু পছন্দের লাইন- -বিপদে সাহস ও শক্তি জোগায়- এই তো প্রেম। -বাংলাদেশ। প্রগাঢ় সবুজ শ্যামলিমা আর আতিথেয়তার এক অপূর্ব পুন্যভূমি। একাত্তরের অর্জন, তিরিশ লক্ষ বাঙালির ত্যাগের ফসল। -নো কিউরিওসিটি, নো কোয়েশ্চেন। এক কথায় বলতে গেলে, এক বসায় পড়ার মতো উপন্যাস। শব্দ ব্যবহারের যথার্থতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ভাল লেগেছে কাহিনীর ধারাবাহিকতা। আর ভাল ছিল বইয়ের কাগজ ও প্রিন্ট। আর সবচেয়ে বড় বিষয় বইয়ের প্রচ্ছদ অবশ্যই যে কাউকে বইটি পড়তে আগ্রহী বানাবে। সর্বোপরি ভাল লাগার মতো একটি উপন্যাস। মোঃ মাহবুবুর রহমান এক্সিকিউটিভ , এম এম ইস্পাহানি লিমিটেড, মতিঝিল, ঢাকা মোবাইল- ০১৭৮২৪১২১৮০ ফেসবুক- Mahbub Nahid
চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংকঃ জীবনসংগ্রাম, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্ব এবং দুর্ধর্ষ মাফিয়া-চক্রের সাথে লড়াইয়ের এক অনবদ্য আখ্যান পাঠক-জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিচার করলে রহস্য, থ্রিলার বা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর অবস্থান সবার উপরে। ছোটবেলায় মূলপাঠ্য বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে "তিন-গোয়েন্দা" পড়েনি, এমন আঁতেল এই বাংলায় একটিও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাস সেই তিন গোয়েন্দা কিশোর, মুসা, রবিনের অনুকরণেই যেন "আধুনিক তিন-গোয়েন্দা সুমন, সায়ান, এমেল"- এর জন্ম দিয়েছেন এই বইটিতে। ফেলুদা, শার্লক পড়ে শৈশব কাটানো প্রজন্মের কাছে রহস্য, থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার হলো মূলত একের পর এক টানটান উত্তেজনায় ভরপুর রহস্যের জট পাকানো কাহিনী, দুর্ধর্ষ গুন্ডাদের সাথে মারামারি এবং পরিশেষে সকল জট সমাধানের মাধ্যমে একটি পরিণত সমাপ্তি। কিন্তু তরুণ লেখক এইরকম গদবাঁধা অ্যাডভেঞ্চার গল্পের পরিমন্ডলের বাইরে গিয়ে এক অনন্য সমৃদ্ধ কাহিনী তুলে ধরার সফল-প্রয়াস করেছেন। এমন একটি গল্প যা পাঠক মনে "শেষ হইয়াও হইলো না শেষ" ধাচের অতৃপ্তি মেশাতে বাধ্য। উচ্চশিক্ষার বাসনায় নিজ জন্মভূমি থেকে দূরে থাকা দুই যুবকের বিদেশের মাটিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম; ঘটনার ক্রিয়াচক্রে ড্রাগ-মাফিয়াদের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসা এক বিদেশী তরুণীর সাথে তাদের পরিচয়, বন্ধুসুলভ খুনসুটি-ভালবাসা; তিন যুবক-যুবতীর মাথা গুজার একমাত্র ঠাঁই ট্র্যাডিশনাল ইউরোপীয়ান ধাচের চৌচালা বাড়িতে ঘটতে থাকা অতিপ্রাকৃতিক কাহিনী এবং তাদের দুঃসময়ে সদা পাশে থাকা একমাত্র ভিনদেশী অভিভাবককে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে চিলিংহ্যাম দুর্গে চার বন্ধুর দুর্ধর্ষ ড্রাগ মাফিয়াদের সাথে লড়াইয়ের এক রোমাঞ্চকর সংমিশ্রণ হচ্ছে "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংক"। লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ুয়া কুড়ি বছর বয়সের সুমন এক অপরূপ মিশ্র চরিত্রের অধিকারী। যে একইসাথে একজন সাহসী, কৌতূহলী, রহস্যপ্রেমিক, কর্তব্যপরায়ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, ভীতু ও দয়ালু মনের অধিকারী। মুহুর্তেই কঠিনতম রহস্যের জট খোলায় মাহির সুমন- আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা নিঃস্ব নেপাল-বংশদ্ভূত এক তরুণকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে এনে জায়গা দেয় তার বাসস্থানে। এমনকি মাঝ রাত্তিরে মাফিয়ার কবল থেকে পালিয়ে বাঁচা এক অ্যাংলো-স্প্যানিশ তরুণীকে আশ্রয় দেয় সুমন। কারণ সুমন অন্যের অসহায়ত্বের সময় স্বার্থপরের মতন গা বাঁচানোর শিক্ষা পায়নি। আবার গ্রামে অমাবস্যায় সন্ধ্যের পর বাইরে যাওয়া বারণ- নিজের উপর এমন স্বঘোষিত কারফিউ জারি করা সুমনই ঘটনার পরিক্রমায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যকে বাঁচাতে মাফিয়াদের ক্ষুরের আঘাতেরও সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি সে সামান্য কারণে বিনা নোটিশে বাড়ি ছাড়তে বলা বাড়িওয়ালিকেও শায়েস্তা করতে পিছপা হয়নি। সুমন চরিত্রটিকে এই গল্পের অন্যতম মূল চরিত্র বলা যেতে পারে। কারণ এই চরিত্রটিই হচ্ছে "আধুনিক তিন-গোয়েন্দা" বাহিনীর লিডার এবং একইসাথে এই গল্পের একমাত্র প্রেমিক-পুরুষ। প্রায় সুমনের সমবয়সী ম্যাকডোনাল্ডসে স্যান্ডুইচ মেকার সায়ান একজন নেপালী-বংশদ্ভূত হাফ-বাঙালি। সুমনের মত সায়ানও ল দেশ ছেড়ে লন্ডনে এসেছে পড়ালেখার তাগিদে। সেন্টিমেন্টাল ফুল, শৌখিন শিল্পী সায়ানের ছবি আঁকায় এবং মেকানিকাল দক্ষতায় জুড়ি নেই। কলেজের ছাত্র সায়ান রান্নাটাও বেশ ভালোই জানে। যদিও সম্পূর্ণ গল্পে সায়ানকে বিপদে পিছ-পা হওয়া আর ভীতুর ডিম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু এই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর অন্যতম প্রধান চরিত্র হচ্ছে সায়ান। গল্পের মূলকাহিনী যে চরিত্রটির আবির্ভাবের পর থেকে শুরু হয়েছে তা হলো আঠারো-উনিশ বছর বয়সী অ্যাংলো-স্প্যানিশ তরুণী এমেল। বয়সের তুলনায় সাহসী এবং বড্ড ডানপিটে এই তরুণীর জীবন কাহিনী যেন কল্প-কাহিনীকেও হার মানায়! তার সৎ মা এক ড্রাগ-মাফিয়া চক্রের সদস্য, যে মাফিয়া চক্র তাকে আটকে রেখেছিল পাচারের উদ্দেশ্যে। মায়ের বিপজ্জনক পেশা থেকে এমেলকে বাঁচাতেই স্বেচ্ছায় দূরে সরে যান তার বাবা। কিন্তু আজও এই তরুণীর দু'চোখ খুঁজে ফিরছে তার সেই হারিয়ে যাওয়া বাবাকে। এমেলের বন্ধু আফ্রো-ক্যারিবিয়ান পিটার মাইক গল্পের এমন একটি প্রধান চরিত্র যাকে ছাড়া হয়তো গল্পটি পরিণতি লাভ করতে পারতো না। যদিও এত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রের দেখা পাঠকরা গল্পের একেবারে শেষের দিকেই পাবেন।সদালাপি, সদাহাস্যময় মাইক যেন এমেলের মধ্যে ছোটবেলায় জাহাজডুবিতে হারিয়ে যাওয়া তার ছোট বোনকে খুঁজে পায়। বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর অনুগামী মাইক একইসাথে দুরন্ত, ডানপিটে, অভিযাত্রী এবং ট্রাপিজ আর্টও জানে। চেহারায় বনেদিয়ানা ভাবের ডেভিড মারটনকে গল্পের একমাত্র প্রধান পার্শ্বচরিত্র হিসেবে ধরা যায়, যে চরিত্রটি কিনা গল্পের সম্পূর্ণ সময়টা ধরে রহস্যময়ী জালে আবৃত ছিল। কোনোরকম যোগসাজশ ছাড়াই "আধুনিক তিন-গোয়েন্দা" বাহিনীর প্রতিটি সংকটাপন্ন মুহুর্তেই তিনি আবির্ভূত হয়েছেন "ওয়ান-স্টপ সলিউশন" হিসেবে। শুরুতে ডেভিড মারটনকে অনেকটা সন্দেহজনক মনে হলেও ঘটনাচক্রে এই চরিত্রটিই হয়ে উঠে তিন তরুণ-তরুণীর একমাত্র ভরসার আবাসস্থল। এমনকি মাফিয়া চক্রের কাছ থেকে এই ডেভিড মারটনকে বাঁচানোর লক্ষ্যে তিন তরুণ-তরুণীর জীবন ঝুঁকি নিয়ে চিলিংহ্যাম দুর্গে যাওয়ার পরবর্তী কাহিনীই ছিল এই গল্পের অন্তিম উত্তেজনা। কোনো গল্পে "থ্রিলার" তকমা লাগানো মানেই কাহিনীতে একজন পাষাণ হৃদয়ের দাগী খুনি, সিরিয়াল কিলার অথবা আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়া লিডার থাকবে, যাকে খুঁজে বের করে খতম করাই কাহিনীর মূল লক্ষ্য। চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংক গল্পটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। আদম-পাচার, ড্রাগ-বিজনেস আর কিডন্যাপিং এর দুর্ধর্ষ মাফিয়া চক্রের প্রধাণ আইরিশম্যান কেভিন ও' নেইল, সাথে রয়েছে তার সাগরেদ ম্যাক্সমুলার। একচোখ কানা, সর্বদা মুখে মুখোশ পড়ে থাকা কেভিন ও ম্যাক্সমুলার গত কয়েক বছর যাবত লন্ডন পুলিশদের "মোস্ট-ওয়ান্টেড" এর তালিকায় রয়েছে। এছাড়াও তাদের দলে রয়েছে এমেলের সৎ মা মিস এলিটা, যিনি কিনা শুধুমাত্র টাকার লোভে এমেলকে ক্যারিবিয়ান মাফিয়াদের কাছে বেচে দিতেও পরোয়া করেনি। ব্রিটিশদের ছোঁয়ায় জাত-ব্যবসায়ী সিপ্রয়েট মহিলা মিসেস ম্যালথামকে এই গল্পের অন্যতম পার্শ্ব লেডি ভিলেন চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না, যার বাড়িতে সুমন সপ্তাহে পঁচাত্তর পাউন্ডের বিনিময়ে একটি পায়রার খোপের মতন জায়গায় ভাড়ায় থাকতো। হাজার রকম শর্ত মেনে চলার পরেও লেডি ম্যালথামের মতন মানবিক আবেগ-অনুভূতিহীন মানুষই পারে শুধুমাত্র আরেক ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে বাড়তি আয়ের আশায় সামান্য কারণে মাত্র ৩ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিতে। শুধুমাত্র এই একটি চরিত্র দিয়েই লেখক অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কষ্টকর-নিষ্পেষিত, পাথুরে বাক্সে বন্দী, প্রাণান্ত মেহনতের যান্ত্রিক বিলেত-জীবনের চিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে আরো কিছু চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়, যেমন- সায়ানের ক্লাসমেট পিটার, মুদিখানার মালিক মিহিরদা, প্রতিবেশী মিসেস বারবারা, লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ফ্রান্সিস জেকব, একজন রেসিস্ট শ্বেতাঙ্গিনী, লন্ডন পুলিশের দুঁদে ডিটেকটিভ- অরগানাইজড ক্রাইম স্টপারস বিভাগের সিনিয়র গোয়েন্দা সার্জেন্ট রিচার্ড লেদেন ওরফে রিক, রিপোর্টার ইয়ান বেল। সম্পূর্ণ গল্প জুড়ে তিন সহযোদ্ধা সুমন-সায়ান-এমেল এর খুনসুটি, রাগ-অভিমান, ভালবাসার মেলবন্ধন দেখা যায়। সুমনকে যেমন সায়ান খুব শ্রদ্ধা করে, তেমনি সুমনের মনের মধ্যেও সায়ান ছোট ভাইয়ের আসন সবার অলোকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অপরদিকে এমেলের কাজই হলো সারাদিন সায়ানের পেছনে লেগে থাকা। বন্ধুসুলভ ঝগড়া, কথায় কথায় টিপ্পনি কাটা, খোঁচা-খুনসুটি ওদের নিত্যদিনের ঘটনা। অবশ্য এমেল-সুমনের সম্পর্কটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। একটুতেই তপ্ত হয়, খানিক বাদে আরক্ত। অমনি শুরু হয় মান-অভিমানের পালা। তবে এমেলকে বরাবরই দেখা যায় সুমনকে একটু সমঝে চলতে- হয়ত শ্রদ্ধা অথবা ভালবাসা থেকে। তবে এইরকম একটি অনবদ্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর ফাকে জাত-ধর্ম-দেশ ভুলে দুটি মানব মন যে আত্মিক প্রেমের সম্পর্কে মিলেমিশে একাকার হয়েছে- তা কোনোভাবেই পাঠকের চোখ এড়ানো সম্ভব না। দুটো মানব হৃদয়ের পারস্পরিক ভালবাসা এবং আকর্ষণের বর্ণনা লেখক এতটাই নির্মোহভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা পাঠকদের জন্য এক অনন্য আকর্ষণও বটে। বাস্তববাদী, কর্তব্যপরায়ণ সুমনের মনে অ্যাংলো-স্প্যানিশ চপলা তরুণী এমেল কখন যে ছোট্ট একটি কুঠুরির দাবিদার হয়ে উঠে তা হয়তো পাঠক নিজেও টের পাবে না। এমনকি গল্পের শেষেও কেবল এই একটা কথাই পাঠক মনে সাড়া ফেলতে বাধ্য- এই পরম নির্ভরতার ভালবাসাটুকুর পরিণতি কি হবে আদৌ? এভাবেই একের পর এক লোমহর্ষক কাহিনীর বদৌলতে এগিয়ে যেতে থাকে গল্পটি। তবে পরিশেষে কি জার্মান শেফার্ডের চোখ পেরিয়ে চিলিংহ্যাম দুর্গে গিয়ে সুমন-সায়ান-এমেল-মাইক কি পারবে মাফিয়া চক্রের হাত থেকে ডেভিডকে উদ্ধার করে বেঁচে ফিরতে? এমেল কি পারবে তার হারানো বাবাকে খুঁজে পেতে? নাকি এক অতৃপ্ত অসুখকর সমাপ্তি নিয়ে পাঠক হৃদয়ক্ষুন্ন হবে? জানতে হলে ঝটপট পড়ে নিতে হবে অরুণ কুমার বিশ্বাসের "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংক"। গল্পের মূল বিষয়বস্তু যে একটি অ্যাডভেঞ্চারভিত্তিক কল্পকাহিনী, তা যে কেউ একনিমিষেই হলপ করে বলে দিতে পারবে বইটির প্রচ্ছদে তুলে ধরা বইটির নাম- "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংক" দেখেই। শুধুমাত্র "আতংক" শব্দটা থেকেই বোঝা যায় বইটির কাহিনী কতটা থ্রিলিং হতে পারে! মিসেস ম্যালথাম বিনা নোটিশে সুমনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার সময় থেকে শুরু করে রহস্যময় জটিল ধনকুবের ডেভিড মারটনের সাথে সুমনের আলাপ, ডেভিড মারটনের থাকতে দেয়া থমথমে বাড়িতে সায়ানের সাথে এক রাতে ঘটে যাওয়া অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা, এমেলের পেছনে তাড়া করে বেড়ানো ড্রাগ মাফিয়ার দল, ডেভিড মারটনের হঠাৎ লাপাত্তা হওয়া, মাফিয়াদের হাত থেকে মারটনকে বাচানোর জন্য চার যুবক-যবতীর চিলিংহ্যাম দুর্গে জীবন ঝুঁকি নিয়ে হানা দেওয়া- সবটাই "আতংক" বই আর কি হতে পারে? এছাড়া গল্পের মূল রোমাঞ্চ পরিক্রমা ছিল চিলিংহ্যাম দুর্গে অবস্থানরত মাফিয়া চক্রকে কেন্দ্র করেই। সুতরাং এই বইটির নামকরণের স্বার্থকতা যথাযথই বলা চলে! এমনকি বইটির প্রচ্ছদটিও যেন নীল-কাল-বেগুনীর আবছায়া তৈলচিত্রের সমন্বয়ে এক অদ্ভুতুরে থ্রিলিং ঘরানার অনুভূতি জাগায় পাঠক মনে। তবে শুধু গল্পের নামটা বাদ দিলে গল্পের অনেকদূর পর্যন্ত আসল কাহিনী উপলব্ধি করার মতো ছিটেফোঁটা সূত্রও ছিল না। এদিক থেকে লেখক অত্যন্ত সফলতার সাথে গল্পে রোমাঞ্চ ধরে রাখতে পেরেছিলেন। গল্পের প্রথম লাইন "সত্যি, বড়ো আজব শহর লন্ডন" থেকে শুরু করে প্রথম কয়েকটি পাতায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে উচ্চশিক্ষার খাতিরে শেকড় ছিড়ে আসা স্বদেশের স্মৃতি-তাড়িত সুমনের এই বিদেশের মাটিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে সুমনের সাথে ডেভিড মারটনের পরিচয়ের সূত্র ধরেই গল্প মোড় নেয় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ভৌতিক এবং রহস্যজনক আঙ্গিকে। আবার গল্পে এমেলের আবির্ভাবের পর থেকে প্রতিটি পাতায় মিশে ছিল ভৌতিক, থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার মিশ্রিত এক টান-টান উত্তেজনা। প্রতিটি পাতা উলটানোর সাথে সাথে গল্পের রস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। এমনকি শেষ করার পরেও মাথার মধ্যে এই দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর ঘোর থেকে গেছে অনেকক্ষণ। অনেক লেখক লেখায় গাম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে অকারণেই গল্প-উপন্যাসে অতিরিক্ত দুর্বোধ্য শব্দযোগ করে থাকেন, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই গল্পের ব্যবচ্ছেদ-উদ্ভব অন্তর্নিহিত অর্থ পরিলক্ষিত হওয়ায় এবং আসল স্বাদ আস্বাদনে বাঁধ সাধে। সে তুলনায় এই বইটিতে একাধিকবার ইংরেজী শব্দের ব্যবহার দেখা গিয়েছে। বর্তমান যুবসমাজের মধ্যে কথায় কথায় বাংলা ভাষার মধ্যে দু-একটি ইংরেজি শব্দ যোগ করার প্রচলন দেখা যায়। ফলে সুমন, সায়ান যেন বর্তমান তরুণ সমাজেরই বাস্তব প্রতিফলক হয়ে উঠে। এছাড়া কাহিনীবিন্যাস সৃষ্টিতে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পে এতটাই সহজবোধ্যতা এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে যে সম্পুর্ণ গল্প শেষ না করে কোনো পাঠকের পক্ষেই উঠা সম্ভব নয়। যারা রহস্য-ভৌতিক-রোমাঞ্চকর গল্প পড়তে পছন্দ করেন, বইটি তাদের জন্য পরম সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে। শেষ করার আগে বাংলার অন্যতম সেরা তরুণ লেখকের সমন্ধে কিছু না বললেই নয়! নটরডেম কলেজে ছাত্রত্বকালীন অবস্থাতেই লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের লেখালেখির হাতেখড়ি। কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস ও সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার অন্যতম ফ্যান অরুণ কুমার বিশ্বাসের জন্ম গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার জহরেরকান্দি গ্রামে। পিতা বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস এবং মা মালতা দেবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করার পর তিনি লন্ডনে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করেন। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ বাংলাদেশে কাস্টমসে অ্যাডিশনাল কমিশনার এবং প্রথম সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত আছেন। বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীতে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস, ভুতুড়ে ও গোয়েন্দা গল্প লেখার এই জাদুগর সমসাময়িক বিষয় নিয়েও বিভিন্ন কলাম লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে এই তরুণ লেখকের লেখার ঝুলিতে জমা পড়েছে প্রায় ৮০ টিরও বেশি গল্প-উপন্যাস। তার লেখা অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার, গোয়েন্দাকাহিনীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলপিপি, স্পাই, কালোকোট রহস্য, অভিশপ্ত পেন্ডুলাম ইত্যাদি। এমনকি সম্প্রতি তার কিশোর থ্রিলার "স্পাই" এসিআই-আনন্দ আলো পুরস্কার অর্জন করেছে। লেখকের "চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংক" ছাড়াও জলপিপি, স্পাই পড়েছি আমি। অবশ্য পড়েছি বললে ভুল হবে, দেদারসে গিলেছি! ফেলুদা, শার্লক পড়ে যাদের শৈশব কেটেছে, তাদের লেখক অরুণের লেখা পছন্দ না হয়ে যাবে না! বাংলার শার্লক হোমসকে আগামী লেখক-জীবনের শুভকামনা রইল। বইয়ের নামঃ চিলিংহ্যাম দুর্গে আতংক লেখকের নামঃ অরুণ কুমার বিশ্বাস বইয়ের ধরণঃ রহস্য, ভৌতিক, থ্রিলার ও অ্যাডভেঞ্চার প্রচ্ছদঃ নিয়াজ চৌধুরী তুলি প্রকাশকঃ পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স লি. প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট, ২০১৯ পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৯৯ আই.এস.বি.এনঃ ৯৭৮-৯৮৪-৬৩৪-২৯০-১ মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৭৫ টাকা রেটিংঃ ৭/১০ রিভিউদাতাঃ দিপ্তী দেবনাথ, বি.এস.এস. (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
চিলিংহ্যাম দুর্গে আতঙ্ক উপন্যাসের কাহিনী চার তরুণের ওপর আবর্তিত হলেও গল্পের মূল নায়ক সুমন। পুরো নাম হিমাংশু শেখর দত্ত। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। পড়ালেখায় বেশি ভালো না হলেও অতো খারাপ না। বন্ধুদের চোখে ভিতু। ভালোবাসে রহস্য। রহস্যের জাল উন্মোচন করতেও মৃত্যুকে পরোয়া করেনা। আশা-ভরা বুক স্বপ্ন-ভরা চোখ নিয়ে জোন থ্রি রোডে লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছে মোহ জাগানিয়া সুন্দরের আবেশ মোড়ানো উর্বশী ও পল্লীবধূর মতো স্নিগ্ধ মমতাময়ী রূপবধূয়া বাংলাদেশ থেকে। । বাসা ভাড়া নেয় মেসেস ম্যালথামের ঘর। এক মাস না পেরোতেই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। রুম ছাড়ার জন্য বাহাত্তর ঘণ্টার সময় দেয় বাড়িওয়ালি। বাড়ি খুঁজতে গিয়ে গাড়িতেই পরিচয় হয় রহস্যময় জেন্টলম্যান ডেবিট মারটনের সাথে। বিনে পয়সার থাকার প্রস্তাব দেন ডেভিট। ভয়, সংশয়, সংকোচ ও উৎকণ্ঠার ঢিবি মাথায় নিয়ে চলে আসে ডেভিটের ঘরে। এ ঘরে তৈরি হতে থাকে একের পর এক রহস্য। শার্লক হোমসের দেশে এসে সবকিছুতে রহস্য না থাকলেও রহস্যের জট পাকাতে সুমনের সময় লাগে না। বিজুলির শিখার মতো চকমকিয়ে বুদ্ধির আলো খেলা করে তার করোটিতে। মুহূর্তেই জটিল থেকে জটিল রহস্য ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে সমাধান করে। এ ভাবে শুরু হয় টানটান উত্তেজনা ভরা কিশোর আ্যডভেঞ্চার উপন্যাস চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক। তারপর স্রোতবাহী নদীর মত তরতর গতিতে উপন্যাসের বাঁকবদল হয়। রহস্যের জালবুননে লেখকের মেধার প্রশংসা যেভাবে করতে হয় শব্দ প্রয়োগে লেখকের কুশলতা ও দক্ষতার প্রশংসা এড়িয়ে গেলে হয়ত কার্পণ্যের তিলক আমার কপালে জুটে যেতে পারে। রহস্যের ধাঁধায় ধাঁধায় যতোটা আমি বিভ্রম হয়েছি লেখকের রস -মাখালো হাস্য রসিকতায় ততো বেশি আমি খিলখিলিয়ে হেসে লুটোপুটি খেয়েছি। চিলিং হ্যাম দুর্গ উপন্যাসের কেন্দ্রস্থল লন্ডন। রহস্যের কুহেলিকায় মলিন হয় নি লন্ডনের কৃষ্টি - কালচার। ফুটে ওঠেছে ওখানকার অধিবাসীদের চাল-চলন ও চিন্তা -চেতনা। লন্ডনের বাস্তবিক চিত্র ফুটাতে কল্পনার রাজ্যে সাঁতরাতে হয় নি। বানোয়াট রূপকথার স্থান নির্ণয় করতে হয় নি। । লন্ডনের পরিবেশ স্বচক্ষে অবলোকন করে সেখানকার আলো বাতাস গায়ে মেখে ফুরফুরে মেজাজে চিলিং হ্যাম দুর্গ উপন্যাসটি ওখানেই লেখেন । রহস্যের আমেজ কাহিনীর শেষ পর্যন্ত লেখক বেশ সফলতার সাথে জিইয়ে রেখেছেন।পাঠক শেষ অবধি না পড়ে গল্পের স্বাদু স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন না। গল্পের বাঁক বদলে ও মোড়ে মোড়ে নতুন নতুন যেমন রহস্যের জট পাকিয়ে পাঠকের হৃদয়- অলিন্দে যেমন ভাবনার পরাগ- রেণু ছিটিয়ে দিয়েছেন ঠিক তেমনিভাবে রহস্যের জট উন্মোচন করে পাঠকের মনের ঘুড়ি জব্দ কর নিজ নাটাইয়ের সুতো দিয়ে ইচ্ছেমতো ওড়িয়েছেন। একটি রহস্য রহস্যই গেলে। আমি কোন কূল-কিনারা ও সমাধান খোঁজে পাই নি। মারটনের ঘরে রাতের অন্ধকারে নিষ্প্রাণ ছবি ফ্রেমের মানুষটি জীবন্ত- জলজ্যান্ত এক নারী মূর্তি হয়ে যাওয়া, নাচের মহড়া, রহস্যময় ছায়াসঙ্গিনীর রহস্যময় পদচারণা, বেলোয়াতি চুড়ির শব্দ,বিলিতি খুশবু,রুমের জানালার শার্সি নামানোর শব্দ। দীর্ঘ আয়তচোখে ভয়াল চাহনি সবমিলিয়ে এক ভয়ংকর সুন্দর রহস্যের জাল ফেঁদেছেন লেখক। লেখক এখানে নীরব।এ রহস্যের কোন সুরাহা লেখকের পক্ষ থেকে আমি পাই নি। হয়ত বুদ্ধিমান তীক্ষ্ণ ধারালো দৃষ্টিসম্পন্ন পাঠকের হাতেই সোপর্দ করেছেন এ রহস্যের গিট খোলার মহা দায়িত্ব। লেখকের অনন্য সৃজনশীলতার পরিচয় ঘটেছে এখানে। সবকিছু রূপসী রমণীর খোলা চুলের মত এলিয়ে না দিয়ে কিছু কিছু বিষয় পরানের প্রেয়সীর খোঁপার মত জমাটবদ্ধ রেখেছেন। এতে পাঠকের তোতার মত অনর্গল পাঠের অভ্যাস যেমন দূর হয় তেমনিভাবে তাঁর দৃষ্টির প্রখরতা ও ভাবনার গভীরতার সীমানা আরো বিস্তৃত হয়।এমন লেখকের লেখায় সচেতন পাঠক খুঁজে পান চিন্তা-ভাবনার মাল-মসলা। ঝালমুড়ি, চনাচুর ও বাদাম ইত্যাদি ছাড়া জাম্পেশ আড্ডা যেমন জমে ওঠে না ঠিক তেমনি নারী চরিত্র ছাড়া কোন গল্প -কাহিনী পাঠককে তেমন একটা বেশি টানে না। পড়তে পড়তে এক ঘেয়েমি বোরিং লাগে। পাঠক যখন বইয়ের গভীরে প্রবেশ করে তখন নতুন কিছু খুঁজতে থাকে। লেখক যদি এ জায়গায় নতুন কিছু দিতে ব্যর্থ হন, পাঠক বিরক্ত হয়ে বইটি সেলফে রেখে দেন। এ জায়গায় আমাদের চিলিং হ্যাম উপন্যাসের লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাস বেশ সফল।দক্ষ হাতে নিপুণ বুননে চাতুরতার চাল চেলেছেন। রহস্যের ধূম্রছায়ায় ও কুয়াশার অস্বচ্ছ কায়ায় পথ চলতে চলতে আমার ওপর যখন ভর করে একঘেয়েমি ও আলসেমি তখন লেখক আমার সামনে উপস্থিত করেন এমেলকে। এমেল এ কাহিনীর একমাত্র নারী চরিত্র না হলে তাকে নায়িকার আসনে রাখতে কোন সমস্যা নেই। তবে এ গল্পে এমেল হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসে নি। তাকে উদ্ধার করতে মধ্যরাতে ছোট-খাটো অভিযানে নামতে হয়েছিল সুমন আর সায়ানকে। এ অভিযানের সফলতাই এমেলকে আমরা খুঁজে পেয়েছি।সায়ানের সাথে এমেলের খোঁচা খুনসুটি বন্ধুত্ব এতোটুকু কিন্তু সুমনের প্রতি কেমন যেন দুর্বলতা ছিল যা মুখ ফুটে বলে নি কোনদিন এমেল। বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে বদলে ফেলার যে দিকটা রয়েছে এমেলের মাঝে লেখক কিছুটা ধারণ করেছেন। চিলিং হ্যাম দুর্গের পরিচয়ও এমেলের হাত ধরে আমরা খুঁজে পেয়েছি। চিলিং হ্যাম কাসল বহু পুরাতন এক রাজকীয় স্থাপনা। চারপাশে ঘন জঙ্গল, দুর্গের সামনে দশ ফুট চওড়া এক পরিখা সবকিছুর মাঝখানে ভুতুড়ে এক চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছে এক সময়ের পরাক্রমশালী আর্ল অফ কেন্টের ভগ্নপ্রায় বাসভবন চিলিং হ্যাম কাসল যার পাশ ঘেঁষে প্রবহমান বিখ্যাত টেমস নদী। এ দুর্গটির নামানুসারে কিশোর থ্রিলার চিলিং হ্যাম দুর্গে আতঙ্ক রচিত।বইয়ের নামকরণ আমার সার্থক মনে হয়েছে এ চমকপ্রদ অদ্ভূত নামটি দেখে বইটি পড়ার আগ্রহ জন্মেছিল এবং হাতে তুলে নিয়েছিলাম। বইয়ের প্রচ্ছদ মোটামুটি ভালো হয়েছে। একটি দুর্গের দরজার সামনে চার কিশোর।টিমটিম করে জ্বলছে দু'টো মোমবাতি, দু'জন গভীর মনোযোগে দুর্গটি পর্যবেক্ষণ করছে। একজন ভাবনার গভীর তলদেশে সাঁতরিয়ে বুদ্ধির মণিমুক্তা কুড়াতে ব্যস্ত অন্যজন পাহারাদারের ভূমিকায় রয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদ আমাকে তেমন একটা টানে নি। বইয়ের প্রচ্ছদ আরেকটু ভুতুড়ে বা রহস্যময় চিত্র হলে হয়ত পাঠককে আকৃষ্ট করতো। তবে লেখক যে আতঙ্ক পাঠকের পাঠকের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত তা সজীব ছিল। তিন কিশোর সুমন, সায়ান, মাইক ও এক কিশোরী এমেল। একটি দুর্গ জয় করা দূর কী বাত, অভিযান চালানোর সম্বল ও পাথেয়ও ছিল না তাদের। কিন্তু চারজনের মাঝে এমন কিছু গুণের সমাবেশ ঘটেছিল যার কারণে এমন এক ভয়ঙ্কর দুর্গে দুর্দান্ত অভিযান পরিচালনা করে শিকারী বাঘের মুখ থেকে তারা নবজীবন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। কী পরিণত হয়েছিল তাদের? কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষে তারা সবাই কী জীবিত ফিরেছিল? না কি মানুষখেকো জার্মান শেফার্ড কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়েছিল। সবকিছুর সমাধান পেতে কোন এক চাঁদনি রাতে মেদুরপাটি বিছিয়ে কিংবা হিম হিম শীতের কোন এক শিশিরঝরা রাতে বইটি আদ্যোপান্ত পড়তে শুরু করুন আর সবকিছুর বন্ধন ছিঁড়ে সময়ের ব্যবধান ছেঁদ করে পাড়ি জমান রুদ্ধশ্বাস টান টান উপাখ্যান চিলিং হ্যাম দুর্গে । জলপিপি পড়ে পা রাখি করি অরুণ কুমার বিশ্বাসের শিল্পের ওঠোনে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের চেয়ে কোন অংশে কম মনে হয়নি অরুণ কুমার বিশ্বাসের গোয়েন্দা অলোকেশকে। জলপিপি পড়ে লেখক ও তাঁর লেখার প্রতি আকৃষ্ট হলাম। লেখক সম্পর্কে জানতে মনটা বেশ আকুলিবাকুলি ও আঁকুপাঁকু করতে লাগল। বিভিন্ন বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা ঘেঁটে-চেটে জানলাম অরুণ কুমার বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ কম্প্লিট করেছেন। ইংরেজি সাহিত্য পড়বার সুবাদে অস্কার ওয়াইল্ড, এডগার অ্যালান পো, আগাথা ক্রিস্টি থেকে শুরু কর সিডনি শেলডন, মারিও পুজো বা আর এল স্টিভেনশনকেও বাদ দেন নি।। নটরডেম কলেজের ছাত্র ছিলেন। ছিলেন রাজপজপড়ুয়া ও গ্রন্থকীট। নটরডেম কলেজে থাকতে প্রায় পাঁচশর মতো বই পড়ে ফেলেছেন । ওখানেই তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি। লেখকের লেখা প্রথম কবিতা ছাপা হয় নটরডেম কলেজের মাসিক পত্রিকা চিটচ্যাট ও ঢাকঢোলে। প্রথমদিকে মাইকেলের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে বের হয় লেখকের প্রথম বই‘নেমেসিস’ ইংরেজি কবিতার বই । স্বদেশের মাটি ও ভাষার টানে পূর্ণ উদ্যোমে বাংলায় লিখা আরম্ভ করেন। লেখক যেমন পাঁড়-পাঠক ঠিক তেমন ভ্রমণপিপাসু। ঘুরে বেড়ানোর সখ।সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান এদেশ ওদেশ। শার্লক হোমসের ডেরা ২২১/বি, বেকার স্ট্রিট দেখবার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি জমান। সেখানে একবছর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করার ফাঁকে ফাঁকে লিখে ছিলেন একাধিক গোয়েন্দা উপন্যাস। ওখানেই জন্ম হয় লেখকের প্রধান গোয়েন্দা চরিত্র অলোকেশ রয়-এর। পিছে ফিরবার প্রয়োজন হয় নি আর।ছড়া, কিশোর গল্প,উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী ও রম্যরচনা লেখে চলেছেন দু'হাতে। ২০০৫-০৬ এ দিব্যপ্রকাশ থেকে বের হয় লেখকের প্রথম দুটো গোয়েন্দাগল্প গ্রন্থ‘ক্রাইম জোন’ এবং ‘অশরীরী’। প্রতি বছর বইলেমায় প্রকাশিত হয় লেখকের বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই। সবমিলিয়ে আশির ঊর্ধ্বে লেখকের বইয়ের সংখ্যা। অরুণ কুমার বিশ্বাসের রয়েছে নিজস্ব শিল্পজগৎ। কারো অনুকরণ ও অনুসরণ নয়, নিজের মতো করে লেখেন।লেখকের গদ্য ঝরঝরে ও প্রাঞ্জল।স্রোতস্বিনীর মতো গতিশীল,বেগবান ও স্বকীয় ধারায় পুষ্ট।সহজ ভাষা। সরল ও সাবলীল বর্ণনাশৈলী। তাঁর বইয়ে পাঠক খুঁজে পান ভিন্ন স্বাদ, অভিনব রস, যা পাঠককে কেবল আনন্দই দেয় না এক সুগভীর তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতায় ঐশ্বর্যবান করে । তাঁর রচনায় খেলা করে বুদ্ধির দীপ্তি, চিন্তার বৈভব ও ভাষার অসাধারণ চাকচিক্য। গভীর রহস্যের জাল বুননে, শব্দপ্রয়োগে, হাস্য রসিকতায় এবং উপমার সুষমা যখন বইয়ের পরতে পরতে চমকায় পাঠক বুঝে নেন এটি অরুণ কুমার বিশ্বাসের সৃজনশীল মেধার ছাপ। আমজাদ ইউনুস হযরত ছিকন খলিফা ছিদ্দীক আহমদ দাখিল মাদরাসা, পটিয়া চট্টগ্রাম নবম শ্রেণি
Its a good children adventure book and i like it very much its a very good book instead