চিলেকোঠার সেপাই
"হাজার চুরাশির মা" বইয়ের লেখিকা বলেছিলেন, "খোয়াবনামার লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পায়ের ধূলা পরিমাণ লেখতে পারলেও নিজেকে ধন্য মনে করতাম।" আমার কাছে যদিও কথাটা বাড়াবাড়ি রকমের লেগেছে।যাহোক। . লেখক জীবনে উপন্যাসই লিখেছেন মাত্র দুইটি(চিলেকোঠার সেপাই,খোয়াবনামা)।চিলেকোঠার সেপাই' ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। কোনো বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বৃহত্তর আন্দোলনের জোয়ারে একজন সাধারণ মানুষের মিলতে সক্ষম হওয়ার গল্প এটি। একটি বিশেষ সময়ে জনজীবনের সমগ্রতাকে, বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের প্রতিটি কোণের মানুষকে লেখক এ উপন্যাসে অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। . এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান গণি ওরফে রঞ্জু দেশবিভাগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসে। ওসমানের বাবা থেকে যান ভারতে, বাবা বেঁচে আছে কি না তা-ও জানে না সে। সবকিছু থেকে সে এতটাই বিচ্ছিন্ন আর ছিন্নমূল যে ঢাকার ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এক বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করাই তার জন্য যথাযথ হয়। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তখন শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিত্যদিন মিটিং, মিছিল, গণআদালত, কারফিউ ভাঙা- ক্ষোভ ও বিদ্রোহে সব স্থানের মানুষ তখন মুক্তির লক্ষ্যে উন্মত্ত। ওসমান গণি সবকিছু দেখে, শোনে, মিছিল-মিটিংয়েও যায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তার বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের চিলেকোঠার চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে তার দিন কাটে। . শহরের আধুনিক উচ্চবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পাশাপাশি বস্তির খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের চোখে একটি গণআন্দোলনের প্রকৃত রুপটি লেখকের অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বর্ণনা-নৈপুণ্যে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। . ওসমানের বন্ধু আনোয়ার বামপন্থি রাজনীতির সক্রিয় সদস্য। যমুনার দুর্গম চর এলাকায় গ্রামে গিয়ে মহাজন জোতদারসহ শহরের কোণায় কোণায় আন্দোলনের উত্তাপ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা বিভিন্ন চরিত্রের বর্ণনা ও ঘটনাপ্রবাহে অপূর্ব নিপুণতায় এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। . আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মহাকবির মতো ছোট ছোট কাহিনীপর্বকে সুন্দর সম্মিলনের মাধ্যমে এ উপন্যাসে একটি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন। লেখকের অতি সূক্ষ্ম এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তিতে উপন্যাসের শব্দে শব্দে একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখায় একেকটি চরিত্রের বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, ঘটনার সাথে চরিত্রের বাস্তবতা, কল্পনা, চেতনা অন্তঃচেতনার মিশ্রণে প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনীবিন্যাসই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। ইতিবাচক রাজনীতির উপস্থাপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অব্যবহৃত পূর্বরূপটি উপস্থাপনে 'চিলেকোঠার সেপাই' একটি অনন্য উপন্যাস।