ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ শরদিন্দু ভট্টাচার্য দর্শন ও বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। এস.এস.সি পরীক্ষায় পদার্থ, রসায়ন, সাধারণ গণিত, ঐচ্ছিক গণিতের সঙ্গে ধর্ম বিষয়েও তিনি লেটার মার্কস অর্জন করেছিলেন। গণিত বিষয়ে এ সাফল্য ছিল আরো উজ্জ্বল। গড় নম্বর ছিল ৯১ শতাংশ। শরদিন্দু একজন কৃতী কণ্ঠশিল্পী। ছাত্রজীবনে সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চ ও বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। এখনো অবশ্য করছেন নিয়মিতই। শরদিন্দু সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যের গবেষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ এম.এ পাশ করার পর নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে করেছেন উচ্চতর গবেষণা। প্রকাশিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থসমূহের অধিকাংশই সঙ্গীত নাট্য বিষয়ক। শরদিন্দু শৈশব থেকেই খানিকটা উদার ও ভাবুক প্রকৃতির। আর তাই জন্মসূত্রে শাক্ত হওয়া সত্বেও বাউল, বৈষ্ণব, সুফি ও তাদের সঙ্গীত বিষয়ে তার সমান আগ্রহ। বাউল-বৈষ্ণব-সুফি শরদিন্দুর একটি মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ। এ গ্রন্থে একই সঙ্গে উদ্ধুত হয়েছে সঙ্গীত, নাট্য ও ধর্ম-দর্শন বিষয়ক আলোচনা। যেহেতু দর্শন, বিজ্ঞান ও সঙ্গীতের সঙ্গে শৈশব থেকেই লেখকের যোগাযোগ, হয়তো সেই জন্যই এ বিষয়ে তার বর্ণনা, আলোচনা, ব্যাখ্যা বিজ্ঞানসম্মত সংস্কারমুক্ত ও স্পষ্ট। শরদিন্দু আমার সন্তান। তার গ্রন্থের বিচার বিশ্লেষণ করা আমার পক্ষে তাই অশোভন। এ দায়িত্ব রইল পাঠকের হাতেই। তাঁরা তার যোগ্য মূল্যায়নই করবেন এ বিশ্বাস আমার সুদৃঢ়।
ভূমিকা মরমী সঙ্গীতের সুর ও ছন্দ আমাদের কাছে সহজে যতটা পৌছুতে পারে, এর অন্তর্নিহিত ভাব ও ভাষা ততটা সহজে পৌছুতে পারে না। বাউল, বৈষ্ণব, সুফি প্রভৃতি মতবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায় যে এতদসংক্রান্ত গ্রন্থের খুব অভাব এমন নয়; কিন্তু এগুলোর বর্ণনা ও ব্যাখ্যা কিছুটা দুর্বোধ্য বা জটিল হওয়ায় বিভিন্ন স্তরের পাঠকের নিকট এর দ্বার থাকে অনুম্মোচিত। সম্ভবত এ কারণেই এখনো অনেকে মরমী গানের শিল্পী মাত্রেই বাউল শিল্পী এবং মরমী গান মানেই বাউলগান মনে করে বিভ্রান্ত হন। আলোচ্য গ্রন্থে সঙ্গীতের উদাহরণসহ এ বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। পূর্ববর্তী মরমী কবিদের সঙ্গে বর্তমান মরমী কবিদের পার্থক্যের বিষয়টিও এতে হয়েছে উপস্থাপিত। আশা করছি মহৎ প্রণীত অন্যান্য গ্রন্থের মতো এ গ্রন্থটিও সর্বস্তরে হবে গ্রহণযোগ্য। গ্রন্থের খসড়া পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে বরাবরের মতো এবারো বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও সহধর্মিণী কিছুটা সময় ব্যয় করেছেন। সুন্দর হস্তাক্ষরের অধিকারী জয়নাল, নীপা, আফরোজা, কাওসার, অপূর্ব ও জয়শ্রীকে এজন্য জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা। সংসারের প্রায় সমস্ত দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে উত্তোলন পূর্বক আমাকে নির্ধারিত সয়ের মধ্যে নিশ্চিন্ত মনে পাণ্ডলিপি প্রণয়নের সুযোগ করে দিয়েছেন আমার বৃদ্ধ মা-বাব। তাঁদের কাছে এজন্য আমি কৃতজ্ঞ নই; ভীষণ ভীষণ লজ্জিত। সম্ভবত আমার যোগ্যতার প্রতি অত্যধিক আস্থার কারণেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্মান দিয়ে প্রাবন্ধিক ও কবি কুমার সুশান্ত সরকার এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে প্রথমে আমাকে
ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য
সাহিত্য ও সংগীতের বিভিন্ন দিকে আগ্রহ থাকলেও ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য মূলত একজন গবেষক। ইতােমধ্যে তাঁর বেশকিছু। গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে সিলেটের বাউলসংগীতে শাহজালাল ও চৈতন্যের প্রভাব, বাউল বৈষ্ণব সুফি, বাঙালির নৃতত্ত্ব ও হিন্দুসভ্যতা, আর্য প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। সিলেটের বাউলসংগীতে শাহজালাল ও চৈতন্যের প্রভাব শীর্ষক গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, নব্যবৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদের মিশ্রণ যেসব অঞ্চলে ঘটেছে, সেসব অঞ্চলেই বাউল, বাওলা বা সে ধরনের মরমীসংগীত সৃষ্টি হয়েছে। বাউল বৈষ্ণব সুফি গ্রন্থে তিনি এই মতবাদগুলাের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা ছাড়াও উল্লেখ করেছেন যে, বড়ু চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি অবৈষ্ণব কবি ছিলেন বলেই তাদের হাতে প্রকৃত অধ্যাত্মরস সমৃদ্ধ কাব্য রচিত হয়নি বা তারা তা করেন নি। চৈতন্য পরবর্তী অন্যান্য। কবি রচিত রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদ অধ্যাত্ম উদ্দেশ্যে রচিত হওয়ার কারণেই পূর্ববর্তী পদ অপেক্ষা স্বতন্ত্র। বাঙালির নৃতত্ত্ব ও হিন্দুসভ্যতা' এবং আর্য’ তার বহুল আলােচিত দুটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থসমূহে তিনি বােঝাতে চেয়েছেন যে, আর্য হিসেবে উল্লিখিত জনগােষ্ঠী ভারতের বাইরে থেকে আগত নয়। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারাের সভ্যতাও যুদ্ধ নয়, প্রবল বন্যাজনিত কারণে ধ্বংস হয়েছে। তবে প্রথমােক্ত গ্রন্থের গুরুত্ব অন্য কারণে। তিনি মনে। করেন, আদি অস্ট্রোলয়েড নামে কথিত নরগােষ্ঠী আফ্রিকা থেকে তৎকালীন স্থল পথে কয়েক সহস্র বছরের চেষ্টায় ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় আসতেই পারে, তবে তাঁর মতে, যখন পৃথিবীর সবগুলাে মহাদেশ একজায়গায় বা খুব কাছাকাছি অবস্থানে ছিল, তখনই অস্ট্রোলয়েড নরগােষ্ঠীর প্রাণকণা একই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকা, ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ভূখণ্ডগুলাে পরস্পর বিচ্যুত হয়ে স্থানান্তরের সময় ওই প্রাণকণাগুলাে বিবর্তিত হতে থাকে। বিবর্তনের মাধ্যমেই স্ব স্ব ভূখণ্ডে একসময় প্রায় কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের নরবানর ও নরের উৎপত্তি ঘটায়। এসমস্ত অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্ত্বিক মিলগুলাের কারণও তাঁর মতে এটাই। উত্তর-আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগর এবং উত্তরপশ্চিম ভারতীয় অঞ্চলের নৃগােষ্ঠীর মধ্যেও সমান্তরাল কারণেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে তিনি এই গ্রন্থে অনুমান করেছেন। ভারতীয় বা বাঙালির নৃতত্ত্ব বিশ্লেষণে এটি একটি নতুন ধরনের চিন্তা বলেই মনে হয়।