"বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলত" বইয়ের লেখকের কথা: বেশ কিছুদিন, প্রায় মাস সাতেক, আগে আমি বর্তমান রচনাটি লিখতে প্রবৃত্ত হই। আমি লিখে যাচ্ছিলাম এবং মরহুম সিকান্দার আবু জাফর প্রতিষ্ঠিত মাসিক সমকালএর একটি সংখ্যায় প্রকাশের জন্য কম্পোজ চলছিল। বর্তমান রচনার প্রায় দুইতৃতীয়াংশের কম্পোজ হয়েছিল, বোধ করি এক ফর্মা ছাপাও হয়েছিল। কী কারণে ঠিক বলতে পারব না, তারপর সমকাল কর্তৃপক্ষ জানান যে লেখাটি তাঁরা বিশেষ কারণে পত্রস্থ করতে রাজি নন। সে যা হোক, অনেকদিন পড়েইছিল। এই সময়ের মধ্যে আমাকে অন্যান্য কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে লেখাটি নিয়ে কোন চিন্তাই করতে পারিনি। বন্ধু-বান্ধব যারা লেখাটি গোড়ার দিকে পড়েছিলেন, তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য তাগাদা দিতে থাকলেও ব্যস্ততার কারণে আমি মনোনিবেশ করতে পারিনি। আমার বন্ধু ফরহাদ মজহার বিদেশ থেকে এসে বারবার বোঝাতে থাকেন যে এই সময় এই ধরনের কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়া উচিত। প্রধানত তারই আগ্রহে লেখাটি শেষ করব, এরকম একটা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ফরহাদ মজহার একা নন, আমার বন্ধু অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক জনাব আফতাব উদ্দিন, জনাব রায়হান ফেরদাউস এবং জনাব মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ প্রমুখ সুহৃদ অবিলম্বে লেখাটি ছেগে বের করার জন্য অনবরত চাপ দিতে থাকেন। এই সময় জনাব কলিমদাদ খান আমার কাছে তার দিগন্ত পত্রিকার জন্য একটা লেখা চাইতে আসেন। অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে জানানো উচিত মনে করছি যে উনিশ শ' চুয়াত্তর সালের মাঝামাঝি সময় এই কলিমদাদ খান সাহেবই আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়েছিলেন। সেই থেকে আমার কবিতা লেখা শুরু। তার আগে কবিতা দু' একটি কালেভদ্রে লিখেছি কিন্তু কবিতার বই বের করব এমন চিন্তা কোনদিন মনে স্থান লাভ করেনি। সুতরাং খান সাহেবের প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা, কিছুটা বিরক্তি দু-ই ছিল। তাকে অসমাপ্ত লেখাটা দেখিয়ে তার কাগজে ছাপাতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি সাগ্রহে রাজি হন। তিনি কম্পোজ করতে থাকেন, আমি লিখতে থাকি। অংশ অংশ করে প্রথম কপিটি লিখেই আমাকে ছাপাখানায় পাঠাতে হয়েছে। তাই বাক্যের বাঁধুনি কোথাও কোথাও শ্লথ থেকে গিয়েছে।
আহমদ ছফা
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চান্দনাইশ থানাধীন গাছবাড়িয়া গ্রামে, এক কৃষিজীবী পরিবারে। বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। স্কুল ও কলেজের লেখাপড়া যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, যদিও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কিছুদিন পদ্ধতিগত গবেষনা করেন। কিন্তু অচিরেই তা ছেড়ে দিয়ে মৌলিক রচনা ও চিন্তাচর্চায় আত্মনিবেশ করেন। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য সাংবাদিকতা, পত্রিকা প্রকাশ, প্রেস ব্যবসা বা এনজিও কার্যক্রমকে পেশা হিসেবে নিলেও, আজীবন লেখালেখিই ছিল তার মূল কাজ। ছাত্রাবস্থায়ই লিখেছিলেন সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, যদিও তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই একটি উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ-কর্ম, শিশু-কিশাের সাহিত্য ইত্যাদি মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশের অধিক। তাঁর পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় ও ‘বস্তি উজার কবিতাটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া ওঙ্কার সহ বেশ কিছু লেখা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওঙ্কার উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। তিনি বেশ কিছু গানও লিখেছেন। গ্যোতের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তাঁর এক অমর কীর্তি। প্রতিষ্ঠানবিরােধী ও প্রতিবাদী বক্তব্যের জন্য আজীবন তিনি ছিলেন আলােচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে। পাশাপাশি নতুন প্রতিভা আবিষ্কার ও তার লালন এবং নবীনদের মধ্যে চিন্তা উসকে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, যদিও এই সংগঠনের দেওয়া পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করেন নি। সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিল্পী সুলতান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কীর্তি। মৃত্যু : ২০০১ সালের ২৮ শে জুলাই, ঢাকায়।