বাদশাহ নামদার
বইঃবাদশাহ নামদার "বাদশাহ নামদার" হুমায়ূন আহমেদের অনান্য সৃষ্টি একটিঐতিহাসিক উপন্যাস। "বাদশাহ নামদার" উপন্যাসের কাহিনী মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের অত্যন্ত আদরের পুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ূন মীর্জাকে নিয়ে রচিত।বাদশাহ বাবর আদরের পুত্র হুমায়ূনকে নিয়ে বড্ড চিন্তিত।পুত্র হুমায়ূন সাম্রাজ্য নিয়ে পুরাপুরি উদাসিন।সে ব্যস্ত থাকে তাঁর রংতুলি আর পদ্য নিয়ে।প্রকৃতির মাঝে তাঁর প্রকৃত সুখ।ওই সময়কালে একবার হুমায়ূন মারাত্মক ব্যাধিে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় পতিত হয়। বাদশাহ বাবর নিজের প্রাণের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন।পুত্রের কালান্তক ব্যাধি সম্রাট ধারণ করে পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।সম্রাট হুমায়ূন সিংহাসনে আরোহন করেও নিজের জগৎ হতে বের হতে পারেননি। মুঘল সাম্রাজ্যের শত্রু শের খাঁর ধূর্ততা,হুমায়ূনের সিংহাসন হারানো, ভ্রাতা কামরান মীর্জার সিংহাস দখলের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি উপন্যাসটিকে রহস্যময় করে তুলেছে। একজন আদর্শ বাবা,আদর্শ স্বামী, আদর্শ পুত্র,একজন দানশীল,ক্ষমাশীল,মানবপ্রেমি, প্রকৃতিপ্রেমি সম্রাটকে হুমায়ূন আহমেদ নিপুনভাবে তার কলমিতে তুলে ধরেছেন। বৈরাম খাঁর সততা,নিষ্ঠা ও সাহসিক সৈনিকের ভূমিকা এবং হামিদা বানুর সাথে হুমায়ূনের রসায়ন পাঠকের মন কেড়ে নিয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে যে কোনো ধরনের নন ফিকশন সহজে লিখা যায়।কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের একজন সম্রাটকে নিয়ে এই স্তরের উপন্যাস লিখা কঠিন।হুমায়ূন আহমেদ এই কঠিন কাজ সহজে করতে পেরেছেন। ইতিহাসপ্রিয় পাঠকদের এই বইটি একবার হলেও পড়া উচিত।
‘বাদশাহ নামদার’ বইটি মোঘল সম্রাট হুমায়ূন মীর্জার জীবনের বিচিত্র সব কাহিনী নিয়ে সাজানো। সম্রাট বাবরের চার পুত্র। কামরান মীর্জা, আসকারি মীর্জা, হিন্দাল মীর্জা ও হুমায়ূন মীর্জা। এঁদের মধ্যে হুমায়ূন মীর্জা সবার বড় এবং রীতি অনুযায়ী তিনিই সম্রাট হন। হুমায়ূন অসুস্থ হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হলে সম্রাট বাবর পুত্রের কালান্তক ব্যাধি ধারণ করে মৃত্যুবরণ করেন। হুমায়ূন সম্রাট হওয়ার পরে তার প্রধান শত্রু শের খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করেন। ছয় মাস ধরে চেষ্টা চালানোর পরে শের খাঁর দখল করা চুনার দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে একদিন তিনি ছদ্মবেশে বেরিয়ে অম্বা নামক একটি মেয়েকে উদ্ধার করে আনেন। অম্বা প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসব। ছয় মাস ধরে সম্রাট হুমায়ূনের বাহিনীকে অপেক্ষা করানো শের খাঁর একটি সুকৌশল ছিল। এই ছয় মাসে শের খাঁ শক্তি সঞ্চয় করেন এবং মিথ্যা একটি দলের বিপক্ষে যুদ্ধযাত্রার কথা বলে হুমায়ূনের বিপক্ষে যুদ্ধের অনুশীলন করেন। এতে করে শের খাঁ মোঘলদের বিশ্বাস অর্জন ও দ্রুত যুদ্ধযাত্রার অনুশীলন সম্পন্ন করেন। হুমায়ূন খেয়ালি মানুষ। শের খাঁ তার এই দুর্বলতাকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে হুমায়ূনের মনোযোগ যেন অন্যদিকে থাকে সেই ব্যবস্থা করেন। তিনি সম্রাটের কাছে তার দুর্বল পুত্র সাইফ খাঁ-কে পাঠান যাতে সাইফ খাঁ পরাজিত হন এবং মোঘলদের কাছে শের খাঁ দুর্বল হিসেবে প্রকাশ পান। শের খাঁর চালাকিগুলোর মধ্যে আরও একটি হল শুক্রবারে যুদ্ধ করা। কারণ মুসলমানরা শুক্রবারে যুদ্ধ করেনা। তবে তার বাহিনীর প্রতি শের খাঁর কঠিন নির্দেশ থাকে হুমায়ূনকে হত্যা করা যাবে না, কারণ তিনি শের খাঁর অত্যন্ত পছন্দের মানুষ। আরও দুটি যে নির্দেশ থাকে যা হল সম্রাটের পরিবারের সমস্ত নারী ও শিশুদের কোন ক্ষতি করা যাবে না এবং সম্রাটের মূল স্তম্ভ বৈরাম খাঁ কে হত্যা করা। শুক্রবার গভীর রাতে ঘুমন্ত মোঘলদের উপর শের খাঁর বাহিনী ঝাঁপিয়ে পরে এবং মোঘলরা পরাজিত হন। ফলে শের খাঁ নতুন সম্রাট হন এবং ‘শাহ’ উপাধি নিয়ে তার নাম হয় শের শাহ। হুমায়ূনকে পালিয়ে যাবার সুযোগ দেয়া হয়। তবে আচার্য হরিশংকর হুমায়ূন কন্যা আকিকা বেগম ও অম্বাকে নিয়ে পালিয়ে যান এবং অম্বাকে গ্রামের মানুষদের হাতে তুলে দেন। গ্রামের মানুষ অম্বাকে আগুনে নিক্ষেপ করে, বান্ধবীকে বাঁচাতে আকিকা বেগম আগুনের ভিতর ঢুকে যায়, ফলে দুজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। শের খাঁ পরে এই খবর জানতে পেরে হরিশংকরকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। হরিশংকর পালিয়ে বেঁচে যান। হুমায়ূন লোকবল যোগার করে কনৌজে যুদ্ধ করেন কিন্তু এবারও তার পরাজয় ঘটে। এর পরে তিনি কামরান মীর্জার মায়ের দেয়া অর্থ আনতে গিয়ে হামিদা বানুর প্রেমে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করেন। এই হামিদা বানুর গর্ভেই জন্ম নেন পৃথিবীর সেরা মহাবীরের একজন, আকবর দ্যা গ্রেট। শের শাহের নির্দেশে তার পুত্র কুতুব খাঁ হুমায়ূনকে রাজ্যহারা করার জন্য অনুসরণ করেন। হুমায়ূন তার ভাইদের প্রতি কখনোই মমতার কোন অভাব দেখাননি। কিন্তু এরপরেও তার ভাইরা তার প্রতি অনুগত থাকেনি। সম্রাট বাবর তার মৃত্যুর আগে হুমায়ূনকে তার ভাইদের প্রতি ক্ষমাশীল থাকতে বলেছিলেন। হুমায়ূন তার কথা রেখেছেন। কিন্তু তার ভাই কামরান মীর্জা শের শাহ-র হাতে হুমায়ূনকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য যাত্রা করেন। এর মধ্যে হুমায়ূন বিভিন্ন দুঃসময় পার করে অমরকোটে পৌঁছান, এখানেই সম্রাট আকবরের জন্ম হয়। কামরান মীর্জা তার ভাই আসকারি মীর্জাকে পাঠান হুমায়ূনকে ধরে আনার জন্য। এই খবর পেয়ে হুমায়ূন তার পুত্রকে ভৃত্যর হাতে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যান। আসকারি মীর্জা আকবরকে নিয়ে লালন পালন করতে থাকেন। অপরদিকে হুমায়ূন হাল ছেড়ে সব ছেড়ে দিয়ে মক্কায় যাওয়ার জন্য পারস্য রাজ্যের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হন। পারস্য সম্রাট হুমায়ূনকে আশ্রয় দিয়ে হুমায়ূনকে রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সৈন্যবাহিনী দেন। তবে এর মধ্যে কামরান মীর্জা পারস্য সম্রাটকে চিঠি দেন হুমায়ূনকে ফেরত দেয়ার জন্য। হুমায়ূন বৈরাম খাঁর নৈপুণ্যে কামরান মীর্জাকে পরাজিত করেন। ফলে তিন বছর পর আকবর তার বাবা মাকে দেখতে পায়। এর মধ্যে শের শাহ কাজ্ঞির দুর্গ পরিদর্শন করতে গিয়ে কামানের বিস্ফোরণে নিহত হন এবং দিল্লির সিংহাসন জালাল খাঁকে দিয়ে যান। কামরান মীর্জা এর মধ্যে লোকবল যোগার করে হুমায়ূনের ওপর হামলা চালায়। হিন্দাল মীর্জা হুমায়ূনকে রক্ষা করতে গেলে কামরান তার ভাই হিন্দালকে হত্যা করে। হুমায়ূন এরপরে বৈরাম খাঁর নৈপুণ্যে দিল্লির সিংহাসন দখল করে নেন। হুমায়ূন বৈরাম খাঁর প্রতিভা ধরতে পেরে তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘খান খানান’ উপাধি দিয়ে ভূষিত করেন। বৈরাম খাঁ হুমায়ূনের মৃত্যুর পরে আকবর সিংহাসনে বসার আগ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন। তবে আকবর সম্রাট হওয়ার পরে বৈরাম খাঁকে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমের হত্যা করেন। এই বইটি সম্রাট হুমায়ূনের নানা চমকপ্রদ কাহিনি দিয়ে পূর্ণ। সম্রাটদের কথা বার্তা, চালচলন, যুদ্ধের কৌশল, মমতাবোধসহ আরও অনেক কিছু রয়েছে এই বইটিতে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এসব কিছু অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বইটি যতবারই পড়ি ততবারই গল্পের রাজ্যে হারিয়ে যাই। বইপোকারা এই বইটি পড়ে ফেলতে পার। #বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯