আরণ্যক
প্রকৃতিকে আমরা কতটুকু চিনি?এই প্রকৃতির রোমান্স,রহস্য,শান্ত অনাবিল সৌন্দর্য্যকে কি আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি?এই যে সুবিশাল অরণ্যরাজি,তাদের কেনো অবহেলা অনাদরে রাখি আমরা?প্রকৃতি যেমন আমাদের আপন করে নিতে জানে,আমরা কেন তা জানিনা? 🙂 আরণ্যক বিভূতিভূষণের এক কালজয়ী উপন্যাস,আমাদের বাংলা সাহিত্যে সে কটি উপন্যাস স্বকীয়তার দাবি রাখে,আরণ্যক তাদের মধ্যে অন্যতম! আরণ্যক এর কাহিনী বিবৃত হয়েছে সত্যচরণ নামের এক বাঙাল যুবকের জবানিতে।বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে বন্ধুর বাবার বিশাল এস্টেট সামলাতে সে পাড়ি জমায় পুর্নিয়া জেলায়।যে ছেলে সারাজীবন কলকাতায় বন্ধুদের আড্ডা,থিয়েটার,বায়োস্কোপ আর বইয়ের পাতায় বুদ হয়ে থেকেছে,তার কাছে বনভূমির এই একাকীত্ব মোটেই ভালো লাগছিল না,ভেবেছিল কিছুদিন পর ইস্তফা দিয়ে চলে যাবে কলকাতায়! কিন্তু এই মায়াবী প্রকৃতি তাকে পেয়ে বসল,ভালোবেসে ফেলল সে এই আরণ্যক কে! এই সুবিশাল অরণ্যের মানুষ আর প্রকৃতি তাকে যেনো ক্রমশ এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ করেছিল! এক একটা দিন ঘোড়ায় লাগাম ছুটিয়ে লবটুলিয়া,আজমাবাদ,নারা বইহার কিম্বা স্বরস্বতীকুণ্ডের ধারে বসে রাত্তিরে একাকী জোৎস্না দেখা,নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা,বনের আদিম প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া এসবকে লেখক সত্যচরণের মধ্য দিয়ে এতো সুন্দর করে তুলে ধরেছেন যা না পড়লে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়! এ উপন্যাসে প্রকৃতির ছায়ায় থেকে অনেকগুলো অমায়িক চরিত্রের প্রবেশ ঘটেছে।বিশাল অরণ্যে নির্বিঘ্ন একাকী জীবনযাপন করা রাজু পাঁড়ে,ছোট্ট বালক ধাতুরিয়া যার মাঝে রয়েছে এক অপূর্ব শিল্পমন,মহাজন ধাওতাল সাহূ যার অঢেল অর্থসম্পদ এর পরেও মানুষের বিপদে এসে পাশে দাঁড়ানোর স্পৃহা,মটকুনাথ পাঁড়ে যার মাঝে ছিল এক অদম্য পরিশ্রমী শিক্ষকের রূপ,আরণ্যকের ভালোবাসায় নিজের জীবন কে উৎসর্গ করা যুগলপ্রসাদ,সরলাময়ী কুন্তা,মঞ্চী কিম্বা ষোড়শী ভানুমতী,রাজ্যহীন রাজা দোবরু পান্না,একেকটা চরিত্র যেন এসেছে আর জীবনের এক একটা গল্প বলে গিয়েছে! আর সত্যচরণ?তাকে নিয়ে আর কিছু নাইবা বলি! "আরণ্যক" কেন স্বকীয়?কারণ প্রকৃতিকে উপজীব্য করে এর আগে লেখা হয়নি এমন অসাধারণ উপন্যাস ,প্রকৃতির চাওয়া পাওয়া,তার সহজিয়া সৌন্দর্য্য,অপূর্ব মুগ্ধতা কিম্বা উত্তাল উন্মক্ত পরিবেশ,তাকে কেন্দ্র করে মানুষের বেঁচে থাকা,সব উঠে এসেছে "আরণ্যক" এর পাতায় পাতায়! প্রকৃত অর্থে এ উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণ নয়,সে শুধু এ উপন্যাসের একজন সেতুবন্ধ মাত্র! আদিম আর আধুনিক সভ্যতার পার্থক্য উঠে এসেছে তার ভাষ্যে!আমাদের এই সাজানো গোছানো সভ্যতা শুধু মেকি,আড়ালে তার সংকীর্ণতা,ধরাবাঁধা নিয়ম,খাঁচার ভেতরে বন্দি পাখির মত তার চলাচল! অথচ ওই বিশাল অরণ্যের মাঝে যেই আদিম বন্য মানুষগুলো রয়েছে তাদের মাঝে এসবের বালাই নেই , ওরা মুক্ত,স্বাধীন।ওরা উদার,সংকীর্ণতা ওদের ছোঁয় না,ওরা সংকোচহীন অথচ ওরা শ্রদ্ধা করতেও জানে! এক অদ্ভুত সাররিয়েলিস্টিক পরিবেশের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলাম "আরণ্যক" যখন পড়ি,উপন্যাস টা যখন শেষের দিকে চলে আসছিল তখন কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল,একটা সুন্দর বইয়ের সার্থকতা হয়তো একেই বলে ☺ হ্যাপি রিডিং ❤ #বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯