নিরাপত্তা ও সুখই যে মানুষের জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা তার স্বাধীনতার হন্তারক―এই ধারণাকে দস্তইয়েফ্স্কি ফিরিয়ে আনেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ’-এ। ‘দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর’-এর মধ্যে দিয়ে তিনি দেখান নিরাপত্তা ও সুখ শেষ পর্যন্ত কীভাবে মানুষের মহত্তম আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দস্তইয়েফ্স্কির জীবনদর্শন ও উপন্যাসভাবনার এই সামগ্রিকতার মধ্যেই পড়া দরকার বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘অপরাধ ও শাস্তি’কে।
‘অপরাধ ও শাস্তি’-এর মূল কথা একজন মানুষের তীব্র মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, সেখানে সে মূলত নিজের সঙ্গে লড়ে। লড়ে নিজের এই অতীত বিশ্বাসের সঙ্গে যে ভাবত একজন সুপারম্যান সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনে একজন ঘৃণিত নিকৃষ্ট মানুষকে খুনও করতে পারে। তাতে সমস্যার কিছুই নেই, বরং তা প্রয়োজনবাদী দিক থেকে যুক্তিগ্রাহ্যই। <br>কিন্তু বাস্তবে এরকম একজনকে খুন করে ফেলার পর ‘অপরাধ ও শাস্তি’-এর নায়ক রাসকলনিকভ তীব্র মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। একসময়ে সে যে ভেবেছিল এই খুন করার আইনি ন্যায্যতা থাকুক বা নাই থাকুক, নৈতিক ন্যায্যতা আছে―সেই ভাবনা সৌধটির ধূলিসাৎ হয়ে যাবার কথাই ‘অপরাধ ও শাস্তি’-এ দস্তইয়েফ্স্কি সবিস্তারে বলেছেন।
ফিওদর দস্তোয়েভস্কি
ফিওদর মিখাইলভি দস্তইয়েস্কি জন্মেছিলেন মস্কোয় ১৮২২ সালে। তখন রাজধানী ছিল সাংকৎ পিতেবুর্গ, ইংরেজিতে যে-শহরকে আমরা জানি সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে। বাবা ছিলেন ডাক্তার । দস্তইয়েফস্কি জীবনভর দুটি রােগে ভুগেছেন একটি দৈহিক, অন্যটি মানসিক । দেহের অসুখ হল তাঁর মৃগীরােগ, আর মানসিক ব্যাধি-জুয়াের নেশা। প্রসঙ্গত, জুয়ােখেলা জার আমলের রাশিয়াতে এত ব্যাপক ছিল যে তাকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে গণ্য করা চলে। লেখাপড়া করেছিলেন সাংকৎ পির্বুের্গের প্রকৌশল বিদ্যালয়ে। জার-বিরােধী এক গুপ্ত রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার কারণে প্রথমে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হলেও পরে তা মওকুফ করে সাইবেরিয়ায় চার বছর সশ্রম কারাদণ্ডের হুকুম আসে।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গরিবগুর্বো মানুষ’ ১৮৪৬ সালে প্রকাশিত হলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। ‘সময় এবং ‘যুগ' নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন, কিন্তু অর্থাভাবে বেশি দিন চালাতে পারেননি। ‘জুয়াড়ি’, ‘ইডিয়ট’, ‘লাঞ্ছিত নিপীড়িত’, ‘কারামাজভ ভাইয়েরা এবং অপরাধ ও শাস্তি’ তার সর্বাধিক খ্যাত উপন্যাসগুলাের অন্যতম। ভূতলবাসীর আত্মকথা’ তার আর-এক ঘুম-কেড়ে-নেওয়া রচনা। তস্তোয়কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল দস্তইয়েফস্কির কোন রচনা তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, তিনি। বলেছিলেন ‘মৃতের শহর’—আরেকটি উপন্যাস। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মস্কোয় কবি আলেক্সান্দর পুশকিন্-এর ভাস্কর্যমূর্তি উদ্বোধনকালে তাঁর বক্তৃতা রুশ সামাজিক ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।