৪৮টি গল্প থেকে পাঠকদের পড়ার জন্য একটি গল্প দেওয়া হলো--টিফিন বক্স
কবির বিন সামাদ
ফাহাদ খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে। আজই প্রথম নয়, সে নিয়মিতই ভোরে জেগে ওঠে। কিন্তু আজ আরও একটু ভোরে উঠেছে। সুবহে সাদিকের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করে নিয়মিত। তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চারিদিকে মোরগের কুক-কুরু-কু আওয়াজ এবং আজানের সুমধুর ধ্বনি ভোরের পরিবেশকে এক স্বর্গীয় রূপ দান করে। এর স্বাদ অনুভব করা একজন বেনামাজির পক্ষে খুবই কষ্টকর। ফাহাদ আজ একটু বেশি ভোরে ওঠার কারণও আছে। জরুরি কাজে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছিল কয়েক দিনের জন্য। আজ আবার ক্যাম্পাসে ফিরতে হবে। বাড়ি থেকে দূরের সফরে যাওয়ার দিনে ফাহাদের নিয়মিত রুটিন হলো, শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের পর মহান রবের কাছে অশ্রুসিক্ত হওয়া। তারপর জিকির-আজগার করে আজান শেষে মসজিদ মুখি হওয়া।
ফজরের নামাজ আদায়ের পরে ইমাম ও মুসল্লিদের সাথে কুশল বিনিময় করে বাড়িতে ফিরলো ফাহাদ। মা যে কখন জেগেছেন তা টেরই পায়নি ফাহাদ। বাড়ি ফিরে দেখে মায়ের নাস্তা বানানো শুধু নয়; মুরগির গোশত পর্যন্ত রান্না করা শেষ। মা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে দিলেন। ফাহাদ তার ছোট বোনকে পাশে নিয়ে বসলো সকালের নাস্তা খেতে। ছিটেরুটি পিঠা আর মুরগির গোশতের ঝোল ফাহাদের খুব প্রিয়। মা সেটা প্লেটে বাড়িয়ে দিলেন। ছোট বোন ফারিয়া মিম অভিমানী কণ্ঠে বলল, ‘আম্মু ভাইয়াকে খুব বেশি ভালোবাসে, আমাকে না।’ ফাহাদ মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমি তো আম্মুর জন্যে স্থায়ী সম্পদ আর তুমি তো ক্ষণস্থায়ী। তাই তোমাকে বেশি ভালোবাসলে আম্মুর কষ্টই বাড়বে!’ ফারিয়া বলল, ‘তুমিই তো ক্ষণস্থায়ী। এই আসো এই যাও।’ ফাহাদ বলল, ‘সময় শেষে আমিই থাকবো মায়ের পাশে, আর তুমি যাবে শশুরবাড়ি, এটাই সত্য।’ ফারিয়া চঞ্চল হয়ে বলল, ‘থাক হয়েছে, এবার তুমি খেয়ে আম্মুকে উদ্ধার করো তো।’ ভাই-বোনের এই খুনসুটি দেখে তাদের আম্মু মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন।
ফারিয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। ক্লাসে ১ রোল নাম্বরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে নিয়মিত। যা ফাহাদের ছিল স্কুলের সময়ে। স্যারেরা এ দু’ভাই-বোনকে নিয়ে খুব গর্ব করেন। খাবার শেষ না হতেই আম্মু স্টিলের টিফিন বক্সটা সামনে রেখে বললেন, ‘যাওয়ার পথে এটা খেয়ে নিস, বাবা।’ ফাহাদ একটু অভিমানের সুরে বলল, ‘এটার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না আম্মু!’ আম্মু বললেন, ‘তুই বাড়ি থেকে চলে গেলে আর তো আমার হাতের রান্না খাওয়াতে পারি না। কী খাস না খাস তাও জানি না।’ ফাহাদ বলল, ‘আম্মু পথে তো আর ক্ষুধা লাগে না।’ আম্মু সাথে সাথে বললেন, ‘তাহলে ক্যাম্পাসে গিয়েই খাবি।’
ফাহাদ আর কথা বাড়ালো না। সে জানে, আম্মুকে এ ব্যাপারে কোনো যুক্তি দিয়ে বুঝানো যাবে না। উঠে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিলো ফাহাদ। উঠানে নেমে দেখে ফারিয়াও স্কুলের ব্যাগ নিয়ে রেডি। মায়ের কাছে সালাম দিয়ে বের হলো দু’ভাই-বোন। ফারিয়াকে স্কুলে রেখে রওনা করবে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে। ফাহাদ কিছু দূর এসেই কি যেন ভেবে পিছনে তাকালো, যা সে কখনো করে না। কারণ তার কাছে মনে হয়, পিছে তাকাং কাপুরুষেরা। কিন্তু আজ যেন বাধা মানছে না মন। মায়ের মুখটি আরেকবার দেখতে চাইলো। ঘুরে তাকাতেই দেখে, মা পাঁচিলের সাথে মাথা লাগানো। চোখ থেকে যেন শ্রাবণের ধারা ঝরছে। ফাহাদের পিছে ফেরা দেখেই শাড়ির আচলে অশ্রু সংবরণের চেষ্টা করলেন আম্মু। ফাহাদের চোখ ভারী হয়ে উঠলো। কষ্ট বুকে চেপে সামনে কদম বাড়ালো।
স্কুলের সামনে এসে ফারিয়া বলল, ‘ভাইয়া, এবার ফেরার সময় আমার জন্যে থ্রি-পিস আনবে। আর তা অবশ্যই লাল রঙের হওয়া চাই।’ ফাহাদ মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল, ‘আচ্ছা আপু আনবো, ইনশাআল্লাহ্! ভালো থেকো আর দোয়ায় শামিল রেখো ভাইয়াকে।’ ফারিয়া মিষ্টি হেসে বলল, ‘ফি আমানিল্লাহ্!’
ক্যাম্পাসে ফিরেছে ফাহাদ। মায়ের রান্না করা খাবারের টিফিনবক্স এখনো খোলা হয়নি। এশার নামাজের পরে খাবারটা খাবে বলে ভেবে রাখলো। শীতের দিন, তাই খাবার নষ্ট হওয়ার আশাঙ্কা খুবই কম। নামাজ শেষ করে আসার পথে ক্যাম্পাসের বড় ভাইয়েরা ডাকলো। ফাহাদ বলল, ‘ভাইয়া খানাটা খেয়ে আসি।’ তারা বলল, ‘পরে খেয়ে নিয়ো।’ ফাহাদ কথা না বাড়িয়ে ওদের সাথে রওনা দিলো। সারারাতে আর ফাহাদের খোঁজ পাওয়া গেল না। ফোনেও কল ঢুকাতে পারেনি কেউ। একদিন, দুদিন, তিনদিন... এভাবে কেটে গেল কত সপ্তাহ, মাস। কিন্তু ফিরলো না ফাহাদ। কেউ তার কোনো খোঁজও দিতে পারলো না। মায়ের হাতের টিফিন বক্সের খাবারও আর খাওয়া হলো না।