‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইয়ের ভূমিকাঃ ইতিহাস : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৫৮ খ্ৰীষ্টাব্দ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বৎসরকে যুগসন্ধি বলা যাইতে পারে। এই সময়ে নানা দিক দিয়া যুগের পরিবর্তন আরম্ভ হয়, তন্মধ্যে “আলালের ঘরের দুলাল” প্রকাশে ভাষা-রীতির পরিবর্তনে বাংলা সাহিত্যের দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনা জাগে। এতদ্ব্যতীত ১৮৫৮ সালেই বেলগাছিয়া নাট্যশালায় ‘রত্নবলী’ নাটকের অভিনয় দেখিয়া মধুসূদনের মনে বাংলা নাটক রচনার বাসনা জন্মে। মধুসূদনের সহিত বাংলাসাহিত্যের সম্পর্ক এই বৎসর হইতে। কিন্তু প্ৰাচীন এবং প্রচলিত ভাষারীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল ইহারও প্রায় চারি বৎসর পূৰ্ব্বে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব করিয়াছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার- উভয়েই হিন্দুকলেজের প্রাক্তন ছাত্র- তথাকথিত “ইয়ং ক্যালকাটা” অথবা “ইয়ং বেঙ্গল”। সুতরাং এই আন্দোলনকে প্রাচীনের বিরুদ্ধে নবীনের অভিযান বলা চলে। ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট ইহাদের সম্মিলিত পরিচালনায় “মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশ আরম্ভ হয়। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার শিরোভাগে এই কয়েকটি পংক্তি বরাবর মুদ্রিত হইয়াছিল এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষতঃ স্ত্রীলোকের জন্যে ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবাৰ্ত্তা হয়, তাহাতেই প্ৰস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই। প্রতি মাসে এক এক নম্বর প্রকাশ হইবেক, তাহার মূল্য এক আনা মাত্র। এই আন্দোলনের দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রুচি ও প্রকৃতি পরিবৰ্ত্তিত হইয়াছে; এই পরিবর্তনকে আজ স্বতন্ত্র করিয়া দেখাইবার উপায় নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের মত প্রতিভার চেষ্টায় এই নূতন ধারা পুরাতন মূলধারাকে পুষ্ট করিয়া তাহার সহিত এক হইয়া গিয়াছে। কেবল “আলালের ঘরের দুলাল পুস্তকখানি পরিবর্তন-যুগের স্মরণ-চিহ্ন স্বরূপ আজিও অক্ষয় মহিমায় বিরাজ করিতেছে। ইহাকে সেই যুগসন্ধিক্ষণের স্মারক-গ্ৰন্থ, এমন কি, নুতন ধারার জয়স্তম্ভ বলিলে অন্যায় হইবে না। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ‘মাসিক পত্রিকা’র প্রথম বর্ষের ৭ম সংখ্যা ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৫) হইতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতে থাকে; তৃতীয় বর্ষের ১১শ সংখ্যা পর্যন্ত পুস্তকের ২৬ অধ্যায় বাহির হয়। ‘মাসিক পত্রিকা’র সকল সংখ্যা আমরা সংগ্ৰহ করিতে পারি নাই। কিন্তু যতগুলি পাইয়াছি, তাহাতে দেখিতেছি, প্রত্যেক সংখ্যায় পুস্তকের এক এক অধ্যায় বাহির হইয়াছে। তৃতীয় বর্ষের দ্বাদশ সংখ্যায় (জুন ১৮৫৭) পুস্তকের ২৭ অধ্যায় বাহির হইয়াছে। “আলালের ঘরের দুলাল' ৩০ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। চতুৰ্থ বর্ষের কোনও সংখ্যাতেই আর ‘আলাল’ প্ৰকাশিত হয় নাই। ইহাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ‘মাসিক পত্রিকা’য় ‘আলাল’ সম্পূর্ণ হয় নাই। এই ক্ষুদ্রকায় ‘মাসিক পত্রিকা’ বাংলা সাহিত্য-সংসারে যে বিপৰ্য্যয় ঘটাইয়াছিল, আজ শতাব্দীকাল ব্যবধানে তাহা অনুমান করা আমাদের পক্ষে সহজ নয়। প্যারীচাঁদ ও রাধানাথ যাহার সূত্রপাত করিয়াছিলেন, কিশোরী –কালীপ্রসন্নের হাতে তাহাই প্রবল আকার ধারণ করিয়া পুরাতনপন্থীদের চিত্তবিক্ষোভের কারণ হইয়াছিল। সে কালের ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় এই বিক্ষোভের পরিচয় আছে। রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁহার ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (ইং ১৮৭৩) পুস্তকে আলালী ভাষা ও রুচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তুলিয়াছিলেন।“আলালী ভাষা” সৰ্ব্বপ্রথম তাঁহার প্রয়োগ। রাজনারায়ণ বসু তাহার ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা' (ইং ১৮৭৮) পুস্তকে আলালী ভাষার সার্থকতা স্বীকার করেন। এই নূতন আন্দোলন সম্বন্ধে আচাৰ্য্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচাৰ্য স্মৃতিকথায় বলিয়াছেন – বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত-বহুল রচনার বিরুদ্ধে একটা revolt হইয়াছিল। বোধ হয়, ১৮৫৪/৫৫ খ্ৰীষ্টাব্দে রাধানাথ সিকদার ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একখানি কাগজ বাহির করেন, তাহাতে অনেক চলিত কথা ব্যবহৃত হইত। একটা প্রবন্ধের মধ্যে ‘Xenophon থেকে ভাঙ্গা’ এই শব্দযোজনা ছিল। বিদ্যাসাগর হাসিতেন। ‘মাসিক পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনি তাহার ‘আলালের ঘরের দুলালে’ সেই tendency’র চূড়ান্ত করিয়া যান। ("পুরাতন প্রসঙ্গ” ১ম পৰ্যায়, পৃ. ৮৮-৮৯) শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁহার ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ পুস্তকে এ-বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন। তৎকালীন আন্দোলনের স্বরূপ বুঝাইবার জন্য তাহা উদ্ধৃত করিতেছি।