ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ তবে তাই হোক। হৃদয়কে পাথর করে বুকের গহীনে বহন করা বেদনাকে সংহত করে দুঃখের নিবিড় অতলে ডুব দিয়ে তুলে আনি বিন্দু বিন্দু মুক্তোদানার মতো অভিজ্ঞতার সকল নির্যাস। আবার আমরা ফিরে তাকাই আমারদের চরম শোক ও পরম গৌরবে মণ্ডিত মুক্তিযোদ্ধের সেই দিনগুলোর দিকে এক মুক্তিযোদ্ধার মাতা, এক সংগ্রামী দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, এ দৃঢ়চেতা বাঙালী নারী আমাদের সকলের হয়ে সম্পাদন করেছেন এই কাজ। বুকচেরা আর্তনাদ নয়, শোকবিহ্বল ফরিয়াদ নয়, তিনি গোলাপকুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপনকার নিভৃততম দুঃখ অনুভূতি। তাঁর ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে, তাঁর আপনজনের গৌরবগাথা যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো বীরগাথার সঙ্গে। রুমী বুঝি কোন অলক্ষ্যে হয়ে যায় আমাদের সকলের আদরের ভাইটি, সজ্জন ব্যক্তিত্ত্ব শরীফ প্রতীক হয়ে পড়েন রাশভারী স্নেহপ্রবণ পিতৃরূপের। কিছুই আমরা ভুলবো না, কাউকে ভুলবো না, এই অঙ্গীকারের বাহক জাহানারা ইমামের গ্রন্থ নিছক দিনলিপি নয়, জাতির হৃদয়ছবি ফুটে উঠেছে এখানে। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়' — এই অমর পঙক্তির মর্মার্থ সামনে রেখে আমরা স্মরণ করতে পারি এক বাঙালি নারী, গৃহবধূ, লেখিকা এবং লড়াকু জননী জাহানারা ইমামকে। স্বাধীনতা — উত্তর বাংলাদেশে এক জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন প্রেরণা ও আস্থার ধ্রুবলোক। তাঁর মধ্য দিয়ে সব অপূর্ণতা পূর্ণ, খন্ড অখন্ডের সঙ্গতি পেয়ে থাকে; আর তিনি জীবনবেদ থেকে উৎসারিত জায়মান চেতনা ছড়িয়ে দেন দুঃসময়ে অসহায় মানবাত্মার সম্পূর্ণ মুক্তির উদ্দেশ্যে। বই নিয়ে বিশিষ্ট জনদের কিছু কথা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। কিন্তু দেখছেন দূর থেকে। যদিও এই গল্প একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা বড় শিল্পী। গভীর আবেগকে সংযত করবার জন্য প্রযোজন হয় একটি পাষাণ হৃদয়ের। সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়ত এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তাঁর ডায়রি। কী অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই না তাঁর গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তাঁর একার থাকেনি। কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প। —হুমায়ূন আহমেদ, বিচিত্রা যে কারণে এই বই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হল ১৯৭১ সালের দীর্ঘ মাসগুলোতে বাঙালিদের আশা — নিরাশা — যন্ত্রণাকে সজীব করে তুলেছে এই গ্রন্থ এবং যে পরীক্ষার তাঁরা সম্মুখীন হয়েছেন ও যে ত্যাগ তাঁরা স্বীকার করেছেন, তার গভীরে দৃষ্টি ফেলতে আমাদের সাহায্য করেছে। — বিবিসি ’৭১ — এর ঢাকা শহরের অবস্থা এবং গেরিলা তৎপরতা বুঝবার জন্য এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। ঢাকায় গেরিলাদের তৎপরতা নিয়ে এত ভাল বই এখন পর্যন্ত আর কেউ লিখেছেন বলে জানিনে। দলিল-প্রমাণাদি সম্পর্কে উদাসীন বাঙালিদের জন্য জাহানারা ইমাম এক অমূল্য দলিল উপহার দিয়েছেন। মনোজ্ঞ বলে এ দলিলের প্রতি উদাসীন থাকা সহজ হবে না কারো পক্ষে। — সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, সচিত্র সন্ধানী একাত্তরের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত দেশবাসীর ওপর নজিরবিহীন বর্বরোচিত হামলা শুরু করার পর অসহায় বাঙালি সেই হামলার প্রথম ধাক্কা সামলে যেভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ক্রমশ তা বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয় এবং দেশের অধিকাংশ মানুষই এতে কোন-না-কোনভাবে অংশগ্রহণ করে — সেই ইতিহাসের একটি স্বচ্ছ চিত্র জাহানারা ইমাম এই পুস্তকে তাঁর ব্যক্তিগত দিনলিপির মাধ্যমে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। — ভয়েস অব আমেরিকা
জাহানারা ইমাম
জন্ম ৩ মে ১৯২৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে। তিনি কলকাতার লেডি ব্রেবাের্ন কলেজ থেকে বি.এ. ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে বি.এড. ডিগ্রি অর্জন করেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সানডিয়াগাে স্টেট কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে ‘সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন’ ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস হাই স্কুলে। ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন ৮ বছর। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ২ বছর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপিকা হিসেবে চাকরি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন প্রভাষক ছিলেন। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। খেলাধুলা, নাটক, সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন সমিতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। খাওয়াতীন’ নামে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দৈনিক বাংলায় কলাম লিখতেন। পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন।
বাবা : সৈয়দ আব্দুল আলী ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ‘বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা সাব-ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট
মা : সৈয়দা হামিদা আলী।
স্বামী : শরীফ ইমাম, প্রকৌশলী
পুত্র : শহীদ মুক্তিযােদ্ধা শাফী ইমাম রুমী সাইফ ইমাম জামী।
এই মহীয়সী নারী ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পুরস্কার : বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার-১৯৮৭, কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার-১৯৮৮, বাংলা একাডেমী সাহিত্য। পুরস্কার-১৯৯১, নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা-১৯৯৪ (ক্রেস্ট), আজকের কাগজ-১৯৯৪ (পদক), গুণীজন সম্মাননা-১৯৯৪ কারমাইকেল। কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ-১৯৯৫ (ক্রেস্ট), স্বাধীনতা পদক-১৯৯৭, বেগম রােকেয়া পদক-১৯৯৮, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-২০০১, ইউনিভার্সাল শিল্পগােষ্ঠী-২০০১ (ক্রেস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ-২০১১ (ক্রেস্ট) লাভ করেন।