একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা - হাসান আজিজুল হক | বইবাজার.কম

একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা

    5 Ratings     1 Reviews

বইবাজার মূল্য : ৳ ১৭৫ (৩০% ছাড়ে)

মুদ্রিত মূল্য : ৳ ২৫০





WISHLIST


Overall Ratings (1)

শেখ মোহাম্মদ জিহাদ
06/09/2019

বইয়ের নামঃ একাত্তর করতলে ছিন্ন মাথা, লেখকঃ হাসান আজিজুলহক, প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ, ধরন: মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক অনেক বছর লেগেছে দেশের অগ্রণী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সেই দিনগুলোর স্মৃতিভাষ্য লিখতে। টুকরো টুকরোভাবে লেখা এইসব স্মৃতিকণিকা একত্রে প্রকাশ পেল ১৯৯৫ সালে, ‘করতলে ছিন্নমাথা’ গ্রন্থনামে। মনে হতে পারে এই নাম বোধকরি প্রতীকী উপমা কোনো, জীবনের নির্মম রসিকতার পরিচয়বহ, কিন্তু এ যে কী নিষ্ঠুর বাস্তবের প্রত্যক্ষ উপস্থাপন যার মধ্যে উপমা-উৎপ্রেক্ষার আড়াল নেই, আবরণ নেই, সজ্জা নেই, পাঠক তা ধীরে ধীরে অনুধাবন করবেন গ্রন্থের পাঠগ্রহণের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে বললাম, কেননা এমন গ্রন্থ দ্রুত পড়বার কোনো উপায় নেই, মাঝেমধ্যে পড়া বন্ধ করে পাঠককে শূন্য মনে উদাস তাকিয়ে থাকতে হবে, চারপাশের কোলাহলময় বাস্তবতা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে, যেমন তাকিয়েছিলেন উকিলবাবু, শেক্সপিয়র মিল্টন-পড়া সেই উকিল, যাঁর তিন পুত্রের লাশ পড়ে আছে রাস্তায়, “কি বিচিত্র শোয়ার ভঙ্গি তাদের! মাটিকে ভূমিবাহু ধরলে একজনের পা ত্রিভুজের মতো ভাঁজ করা, অন্য পা মেলে দেওয়া। ছোট ছেলেটি, রাজপুত্রের মতো চেহারা, টকটকে ফর্সা রঙ, টিকোলো নাক, লাল গোলাপের পাঁপড়ির মতো ঠোঁট, হাঁটু ভাঁজ করে তলপেটের কাছে গুটিয়ে নিয়ে যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মেজভাই দলামোচড়ানো, ডান বাহুর নিচে প্রায় ছিন্ন মাথা, দুই চোখ চেয়ে চেয়ে রয়েছে, বাঁ হাতটি বড়ো ভাইয়ের গলার ওপর মেলে দেওয়া। কি নিশ্চিন্তে আরামের শুয়ে থাকা।” এই দৃশ্য অবলোকনের পরপরই হাসান আজিজুল হক দেখতে পান সামনের দোতলার বারান্দায় উকিলবাবু আকাশের দিকে মুখ তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। “আমি একদৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি, এই ভেবে যে তিনি দৃষ্টি নামাবেন, হয়তো আবার, আবার দেখে নিতে চাইবেন তাঁর তিন আত্মজের মুখ; কিন্তু আমার অপেক্ষা বৃথা হলো, আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন, তাঁর মৃত সন্তানেরা শুয়ে রইলো শেষ মার্চের তীব্র রোদে পিচ গলে-যাওয়া রাজপথে।” নিরাবেগ নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে লিখে গেছেন হাসান আজিজুল হক, শক্তহাতে শাসন করেন আবেগের সমস্ত প্রকাশ, কিন্তু কীভাবে যেন রচনার ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে পড়ে পরম সংবেদনশীলতা ও নিবিড় মমতা, যদিও তার কোনো ছাপই খুঁজে পাওয়া যাবে না তাঁর বর্ণনায় কিংবা গদ্যে। যে-দৃশ্য উকিলবাবু দেখছেন না, দেখতে পারছেন না, তাই আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁর দৃষ্টি, তেমনি পাঠকের মনও আচ্ছন্ন করবে যা লেখা হয়েছে তা নয়, যা লেখা হয়নি, দুই লাইনের মধ্যকার সেই ফাঁকা অংশ, দুই শব্দের মধ্যকার চুপকথা, সেসবই হয়ে উঠবে সর্বনাশের কিনার-ঘেষা বিশাল গহ্বর, দৃষ্টি ও মনকে টেনে নিয়ে যাবে অসীম অতলে, চোখে ভর করবে এমন আঁধি, তাকানো আর তাকানো থাকবে না, দৃষ্টিতে থাকবে না কোনো অবলোকন। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাধারার টুকরো ছবিতে মিলবে দুই মানুষের প্রতিকৃতি, খুলনার সুন্দরবন কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক খালেদ রশীদ, নকশাল আদর্শে উদ্বেলিত হয়ে নিজেকে করেছিলেন সমাজচ্যুত। তারপর পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করতে গিয়ে এপ্রিলের প্রান্তিক কোনো এক দিনে হারিয়ে গেলেন চিরতরে। আর দশজনের সঙ্গে খালেদ রশীদের সখ্য ও প্রীতির বন্ধনের পরিচয় দেন হাসান, বলেন না কেবল আপনকার অনুভূতি, বরং চরম এক শৈত্যে চাপা দিতে চান অন্তরের উষ্ণতা। শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে কাজ করা রফির পরিচয় তিনি দিয়েছেন তাঁর স্বভাবসুলভ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে আর এই রফিকে হত্যার পর নির্দয় রাজাকার তাঁর মুণ্ডু যখন ঝুলিয়ে দেয় গুড়িয়ে-দেয়া শহীদ মিনার-সংলগ্ন সুপারি গাছটায়, তখন আবার এমন নিস্পৃহ বর্ণনায় মেতে ওঠেন হাসান, পড়তে পারা যায় না সেসব কথা, ভাবতে অবাক লাগে কেমন করে নিষ্ঠুরতার এমন ভাষ্য লিখতে পারলেন তিনি! না, তিনি লেখেন নি, ইতিহাসই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এইসব কথকতা, ভয়ঙ্করতম ইতিহাসের দায়মোচনের জন্য হূদয়কে পাথর করে কষ্ট বুকচাপা দিয়ে কলম হাতে লেখালেখি, আকারে বিশাল নয় কিন্তু তাৎপর্যে অপরিসীম। সেই প্রথম যখন গদ্যচর্চা শুরু করেন হাসান আজিজুল হক, আমাদের মতো তরুণদের মাতিয়ে তুলেছিলেন তাঁর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী গদ্যভঙ্গি দ্বারা। মনে পড়ে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের সূচনাংশের সেই অসাধারণ বর্ণনা, “অল্প বাতাসে একটা কচি কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।” এরপর প্রায় পঁচিশ বছরের অপেক্ষান্তে প্রণীত একাত্তরের কথকতার এই গ্রন্থের শুরুর বাক্যে তিনি লিখলেন,আমার জানা ছিল না যে পানিতে ভাসিয়ে দিলে পুরুষের লাশ চিৎ হয়ে ভাসে আর নারীর লাশ ভাসে উপুড় হয়ে। একটি মাত্র বাক্য যেন সুনামির মতো আছড়ে পড়ে বুকে, জাগায় তোলপাড়, অল্প বাতাসে একটা কচি কলার পাতা পানিতে ভাসিয়ে দিলে একবার বুক দেখায় পুরুষের লাশ চিৎ একবার পিঠ দেখায় আর নারীর লাশ উপুড়— একাকার হয়ে যায় অতীত ও বর্তমান, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব, খসে পড়ে জীবনের সব উপমা ও অলঙ্কার। জেগে থাকি আমরা, করতলে ছিন্নমাথা, যে ছিন্নমস্তার দিকে ফেরাই না চোখ, ফেরাতে। #বইবাজার_মাসিক_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_সেপ্টেম্বর_২০১৯


PAYMENT OPTIONS

Copyrights © 2018-2024 BoiBazar.com