আগুনপাখি (প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১২) (হার্ডকভার)
বইবাজার মূল্য : ৳ ২৭৩ (২২% ছাড়ে)
মুদ্রিত মূল্য : ৳ ৩৫০
প্রকাশনী : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
বিষয় : ঐতিহাসিক উপন্যাস , মাস্ট রিড ১০০
বইটা কয়দিন ধরেই পড়ছিলাম কিন্তু শেষ হচ্ছিল না কাজের ব্যস্ততায়। আজ ডে অফ থাকায় কাল সারারাত পড়লাম। অসম্ভব ঘুম পেলেও চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। বইটা মন্ত্রমুগ্ধের মত চোখ টেনে খুলে রেখেছে। ভোর সাড়ে ছটায় যখন শেষ করলাম তখন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম থম ধরে। বারবার মনে হচ্ছিল কি পড়লাম! অদ্ভুত বা অসাধারণ বললে কি সেই মুহুর্তের অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব? সম্ভব না। প্রতিটা ভালো বই পড়ার পরে এমন হয়। কিছুটা অবসাদও চেপে বসে এই ভেবে যে এমন কিছু আমার দ্বারা জীবনেও লেখা সম্ভব না! বইয়ের ভূমিকা পড়ে দেখলাম হাসান আজিজুল হক নাকি চল্লিশবছর সময় নিয়েছেন নিজের প্রথম উপন্যাস লিখতে। বইটা পড়ে মনে হচ্ছিল চল্লিশ বছর ধরেই বইটার প্লট এবং চরিত্র একটু একটু করে দানা বাঁধছিল তার মনের মধ্যে। পুরো বইটা লেখা হয়েছে আঞ্চলিক ভাষায়। তাই ভাষা নিয়েও নিশ্চয় দীর্ঘ গবেষণা করতে হয়েছে। বইয়ের কাহিনী বর্ণনা হয়েছে এক নারীর জবানিতে। যে নারী কোনদিন নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়নি। যে নারীর জীবন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয় তার পিতা, তারপর স্বামী। এমনকি ঘরের বাইরে বের হওয়ারও অনুমতি নাই স্বামীর কাছ থেকে। এই নারীর জবানিতেই পাই সেসময়ের সমস্ত নারীর জীবন কীভাবে বাড়ির অন্দরমহলের চৌহদ্দির মধ্যেই কেটে যেত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। রাতের আঁধার ছাড়া প্রসাব-পায়খানা পর্যন্ত আটকে রাখতে হত। আরও পাই মানুষের জীবন কতটা অনিশ্চিত ছিল। জন্ম এবং মৃত্যু হাতে হাত ধরে চলত যেন। মানুষের পুরো জীবনযাপন, খাওয়া-পরা নির্ভর করত প্রকৃতির খেয়ালের উপর। এই নারীর জীবন যখন তার সন্তানরা নির্ধারণ করতে চায় তখনই দেখি যাকে এতো সামান্য এতো তুচ্ছ বলে মনে হয় সে আসলে অত সামান্য নয়। তার ভেতরেও রয়েছে নিজস্বতার শক্তি। সেও শক্ত করে 'না' বলতে পারে যখন তাকে কেউ বোঝাতে পারেনা শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে কেন দেশ ভাগ হবে।
#বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯ 'আগুনপাখি' উপন্যাসের লেখক, বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র, হাসান আজিজুল হক। পুরো উপন্যাস বয়ান করেছে এক নারী, চার দেয়ালের মাঝে যার জীবন। বাপের বাড়ি থেকে তার শ্বশুর বাড়ি আসা। সেখানে হেঁসেল ঠেলেই যার সময় যায়। সেই পুরনো নিয়ম। বিরাট তার সংসার, যেখানে কর্ত্রী তার শাশুড়ি। সেই সংসারের কাহিনী বয়ান করে সে নারী। সঙ্গে থাকে সেই সময়ের কিছু কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, তারপর দেশভাগ। আর সে সব আমরা শুনতে পাই তার জবানে, তার ভাষায়। উপন্যাসে মুখ্য চরিত্রের মুখেই আমরা শুনতে পাই সবকিছু। তার দৃষ্টিতেই দেখি সব। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক থেকে শুরু করে সংসারের খুঁটিনাটি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে গল্প বারমুখো হয়। আস্তে আস্তে উঠে আসে সেকালের রাজনীতির খবর। রাজনীতির সাথে থাকে সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। ধীরে ধীরে সময় বদলায়, বদলায় সংসার, বদলায় জীবন। আমরা সে বদলের যাত্রায় সঙ্গী হই। হাসান আজিজুল হকের এই উপন্যাসের প্রশংসা করেছেন সবাই। পেয়েছে আনন্দ পুরষ্কার, প্রথম আলো পুরষ্কার। উপন্যাস হিসেবে ‘আগুনপাখি’ উপন্যাস নিজ গুণে গুণান্বিত। কিন্তু কেন যেন মনে হয়েছে হাসান আজিজুল হকের যে লেখনি শক্তি, তার লেখার যে ধার, তার পুরোটা এই বইয়ে নেই। প্রথমেই বলেছি, এ গল্পের কথক এক নারী, যার গণ্ডি সীমিত। সুতরাং, দেশভাগ সম্পর্কে কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষণে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই এই উপন্যাসে। সুতরাং, তা আশাও করিনি। তাহলে উপন্যাসে থাকবে কেবল ঘরোয়া বিষয়, সংসারের কথা? হতে পারতো, কিন্তু কেবল এই নারীর প্রেম-বিষাদ দেখানো লেখকের উদ্দেশ্য ছিল না। তার মূল লক্ষ্য দেশভাগকে উপজীব্য করে সেই সময়ের কথা বলা। সংসারের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি উপস্থাপন করেছেন তা। সংসার ভেঙে টুকরো হওয়ার সাথে দেশ ভাঙ্গার একটা তুলনা হতে পারে, কিন্তু দেশভাগের যে ক্ষত লেখক শেষটায় দেখিয়েছেন, তার পুরোটা কি বেজেছে পাঠকের ভেতরে? যে মাটি নিয়ে সে নারীর কথা, কেন সে মাটির প্রতি তার এতো টান, সেটা কি পরিষ্কার হলো? হাসান আজিজুল হকের গল্প পড়ার সুবাদে জানি তা মর্মে বাজে। কিন্তু এই উপন্যাস কেন যেন হৃদয় তন্ত্রী ছুঁয়ে গিয়েও সুর তুলতে পারলো না আমার। অনেক কিছু থেকেও কি যেন নেই বলে মনে হল। হাসান আজিজুল হকের গল্পের ছোট পরিসরের মাঝেও যে বিশাল এক আবহ থাকে, দূরের কোন সুর বাজে, তা এখানে পেলাম না। দেশভাগের যে ক্ষত দুই তিন লাইনে ফোটে, এখানে দুইশ পৃষ্ঠায় তা ফুটেও ফোটে না। উপন্যাস হিসেবে আগুনপাখি পূর্ণ নম্বর পেলেও, হাসান আজিজুল হক এখানে নিজেকে পুরোপুরি ছুঁতে পারেননি, এ হয়ত আমার অনুভূতি। অন্য কারও এমন মনে হয়েছে কিনা জানি না। হলে তার কারন কি? ছোটগল্প থেকে উপন্যাসে আসা? এখানে বলে রাখা ভালো, হাসান আজিজুল হকের একটি ছোটগল্প 'একটি নির্জলা' কথা থেকে আসলে তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন। গল্পটির আগে পিছে আরও গল্প যোগ করা হয়েছে আর মূল গল্পটাকে লেখক কঙ্কাল বা ভিত্তি হিসেবে ধরেছেন। তবে কি গল্পের গায়ে রক্ত মাংস ঠিক জোড়েনি বলেই একটু আলগা ভাব? কিংবা এ আমার ভ্রান্তি।