"আধ্যাত্মিক জগত ও আত্মশুদ্ধির পথ"বইটির ভূমিকা :
তাসাওউফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মূলতত্ত্বের ব্যাপারে কারাে কোন দ্বিমত নেই। এটি অতি সুস্পষ্ট একটি বিষয়। কিন্তু দুটি বস্তু এর ক্ষতি সাধন করেছে। প্রথমটি হচ্ছে তাসাওউফ সংক্রান্ত মাধ্যম পর্যায়ের বিষয়গুলােতে চরমপন্থা অবলম্বন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পরিভাষার ক্ষেত্রে প্রয়ােজনাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান এবং এ বিষয়ে অনর্থক বাড়াবাড়ি।
যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়- ইখলাস ও আখলাক অর্জন করা জরুরী কি না? ইয়াকীন (দৃঢ় বিশ্বাস) কাম্য কি না? সৎগুণাবলী সম্পন্ন হওয়া, দোষ-ত্রুটি হতে বেঁচে থাকা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, রিয়া, সম্পদের লােভ, মান-সম্মানের মােহ এবং অন্যান্য আত্মিক রােগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া, কুপ্রবৃত্তির তাড়না থেকে দূরে থাকা জরুরী কি না? এমনিভাবে নামাযে একাগ্রতা, কান্নাকাটি করে বিনীতভাবে দুআ করা, নফসের হিসাব নিকাশে অভ্যস্ত হওয়া, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত- সে মহব্বতের স্বাদ ও তৃপ্তি অনুভব হওয়া অথবা তার আগ্রহ। রাখা, এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া, লেনদেন পরিষ্কার রাখা, সততা, আমানতদারী, বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করা, আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম হওয়া, রাগের সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যাওয়া- এসব কাম্য কি না?
সুস্থ বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ এক্ষেত্রে একটি উত্তরই প্রদান করবে যে, এগুলাে শুধু ভালই নয়; বরং শরীয়তে কাম্যও বটে। অবশ্য গোড়াপ্রকৃতির লােকদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। কুরআন ও হাদীসের বিশাল ভাণ্ডার এসবের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও গুরুত্ব আরােপ সংক্রান্ত বর্ণনায় পরিপূর্ণ।
কিন্তু যদি বলা হয়- ঐসব গুণাবলী অর্জনের মাধ্যম হচ্ছে সে কর্মপদ্ধতিই যা পরবর্তীতে তাসাওউফের নাম ধারণ করেছেতখন তাসাওউফ শব্দটি শােনামাত্রই কিছুলােকের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়। এর কারণ হল, এ পরিভাষার প্রতি তাদের ভীতি জন্মেছে এবং তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে স্বয়ং তথাকথিত সুফীদের সম্পর্কে। সে সময় তাদের মানসপটে তথাকথিত সুফীদের ঐসব ঘটনা ভেসে ওঠে, যা কার্যক্ষেত্রে বা নিকট থেকে তারা দেখেছেন বা তাদের সাথে ঘটেছে। কিন্তু এরূপ ঘটনা শুধু তাসাওউফের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, বরং সকল শাস্ত্র, প্রতিটি ইসলাহী দাওয়াত এবং প্রত্যেকটি নেক কাজের একই দশা। তার ধারক-বাহকদের মধ্যে তার আহ্বায়ক এবং দাবীদারদের মাঝে বিদ্যমান ছিল খাটি মেকি, অভিজ্ঞ অনভিজ্ঞ, পরিপক্ব অপরিপক্ক, সত্যবাদী মুনাফেক সব প্রকৃতির মানুষ। এতদসত্ত্বেও কোন তত্ত্বসন্ধানী ব্যক্তিই মূল বিষয়টির প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করতে বা তার বিরােধিতা করতে পারে না। পার্থিব বিষয়াবলীরও একই অবস্থা। ব্যবসা, কৃষি, কারিগরী, শিল্প প্রত্যেকটিতে পাশাপাশি দু'ধরনের লােক পাওয়া যায়। পরিপক্ব অপরিপক্ব, ভাল মন্দ, সাধু অসাধু। অথচ দীন দুনিয়ার সমস্ত কার্যাবলী আপন গতিতে চলছে। মানুষ থেমে নেই। সবাই নিজ কাজ করেই যাচ্ছে। অপরিপকৃতার কারণে মানুষ দৌলত হতে বঞ্চিত হচ্ছে না। আপন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে না। পরিভাষাগত কোন বিভেদের কারণে আসল হাকীকত বা মূল বস্তুকে বর্জন করছে না। কবি সত্যই বলেছেন
الفاظ کے پیچوں میں الجھتے نہیں دانا غواص کو مطلب هے گهر سے کہ صدف سے
‘জ্ঞানীগণ শব্দের প্যাঁচে হারিয়ে যান না; বরং উদ্দেশ্য থাকে মূলতত্ত্বে পৌছার। বলুন, ডুবুরির মুক্তা আহরণ উদ্দেশ্য থাকে, নাকি ঝিনুক আহরণ।